সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

হাসপাতালে লিফট দুর্ঘটনা

কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হতে হবে

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারি হাসপাতালের লিফট আতঙ্কের আরেক নাম হয়ে উঠেছে। লিফট দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনার সংবাদ যেভাবে আসছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। শুধু গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ছয় মাসে তিনবার লিফট দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালটিতে সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ১ অক্টোবর রাতে, শিশুসন্তানের চিকিৎসা করাতে এসে জাহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি মারা যান। এই মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক। সন্তানকে সুস্থ করতে হাসপাতালে আসা বাবার এই মৃত্যুতে স্বজনেরা কীভাবে সান্ত্বনা পাবেন?

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, জাহিদুল তাঁর অসুস্থ সন্তানকে হাসপাতালের ১০ তলায় শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছিলেন। ১ অক্টোবর রাতে নিচে নামার জন্য জাহিদুল ১০ তলায় লিফটের বাটনে চাপ দেন। কিছু সময় পর লিফটের দরজা খুলে যায়। লিফটের মেঝে ফাঁকা ছিল। তিনি ভেতরে পা দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেটি নিচে পড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর শ্যালিকাসহ অন্য কয়েকজন রোগীর স্বজন অল্পের জন্য রক্ষা পান।

হাসপাতালে দায়িত্বরত একজন আনসার সদস্য যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির বিষয়টা স্পষ্ট। তাঁর ভাষ্য হলো, লিফটটিতে কয়েক দিন ধরে সমস্যা ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, কাউকে সতর্কও করেনি। কিন্তু হাসপাতালের পরিচালক অবশ্য বলছেন, লিফটটা সচল ছিল না। কীভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, তদন্ত করে দেখা হবে।

যে হাসপাতালে আগে দুবার লিফট দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কয়েক দিন ধরে লিফটে সমস্যা থাকার পরও সেটা মেরামতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াটা দুঃখজনকই নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়কও। এটা নিছক দুর্ঘটনা, নাকি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। দেশের সবখানেই জবাবদিহি না থাকার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, এটা তারই প্রতিফলন।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া হাসিনা সরকারের আমলে অন্যান্য খাতের মতো স্বাস্থ্যের অবকাঠামো নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। এর পেছনে যতটা না জনগণের সেবা নিশ্চিতের বিষয়টি কাজ করেছে, তার চেয়েও বেশি ছিল নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি। দুর্নীতি, অনিয়মনির্ভর এই ব্যবস্থা দায়মুক্তির একটা সংস্কৃতি তৈরি করেই টিকে থাকে।

তাজউদ্দীন হাসপাতালে লিফট দুর্ঘটনায় কেন মানুষ মারা গেল, এ নিয়ে অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করতে হবে। আগের দুটি দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটি ঠিকভাবে কাজ করেছে কি না, কিংবা তারা যে সুপারিশ দিয়েছে, সেটা কেন বাস্তবায়িত হয়নি, সে বিষয়গুলোও তদন্ত হওয়া জরুরি। দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। লিফট দুর্ঘটনার নামে এই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়া দরকার।