সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

পুরো টাকাই কি জলে গেল

চুড়িহাট্টার আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর পর রাজধানীর শ্যামপুরে রাসায়নিকের গুদাম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রকল্পের শুরু। কথা ছিল, ১০ মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হবে।

তবে সময় লেগেছে প্রায় চার বছর। এখন ব্যবসায়ীদের বড় অংশ বলছে, তাঁরা অস্থায়ী গুদামে যেতে চান না। এই অনীহার পেছনে তঁারা কিছু কারণ দেখিয়েছেন। কারণগুলো একেবারে ফেলনা নয়।

প্রশ্ন হলো, অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের পরিকল্পনায় যারা যুক্ত ছিল, সেই শিল্প মন্ত্রণালয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছিল? কিংবা যথেষ্ট পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে কি তারা এই ৫৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করেছে?

কেন এই প্রশ্ন, তা ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ডিএসসিসি এর আগে ২০২১ সালে জরিপ চালিয়ে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ১ হাজার ৯২৪টি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। এসব স্থাপনার সব কটিই ছিল কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে প্রায় দুই হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই স্থানান্তর করা প্রয়োজন, সেখানে অস্থায়ী গুদাম করা হয়েছে ৫২টি প্রতিষ্ঠানের জন্য।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ব্যবসায়ীদের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, গুদামের সংখ্যা কম ও ভাড়া বেশি হওয়ার কারণে তাঁরা রাসায়নিক গুদাম ব্যবহারে আগ্রহ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ আশা করছে, তারা ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক গুদামগুলো পুরান ঢাকা থেকে শ্যামপুরে সরিয়ে নিতে পারবে। ৫২টি গুদামের স্থানান্তর অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কতটা কমাবে?

পুরান ঢাকার রাসায়নিকের ব্যবসা ওই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য অভিশাপ। ফি বছর অগ্নিকাণ্ডে সেখানে প্রাণ ঝরছে। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে ১২৫ জনের প্রাণহানির পর থেকেই আমরা শুনে আসছি, গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে। প্রথমে বলা হলো রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে কেরানীগঞ্জে নেওয়া হবে, কিন্তু হয়নি।

চুড়িহাট্টায় যখন আবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তখন সরকার বলল, কেরানীগঞ্জে নয়, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিক পল্লি হবে। সেই প্রকল্প ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেছেন, সবকিছু ঠিক থাকলে এ বছরের শেষ নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। ‘সবকিছু’ বলতে তিনি ঠিক কী বুঝিয়েছেন, তার অবশ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই।

যদি ধরে নেওয়া হয় এ বছরের শেষে মুন্সিগঞ্জে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে, তাহলে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্যামপুরে যে গুদাম হলো, সেগুলোর কী হবে? সরকারের উচিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে এর একটা বিহিত করা। অবশ্য এমন কত কোটি টাকাই তো ‘দরিয়া মে’ ঢালা হলো। যাঁদের কারণে এত অপচয়, তাঁদের তো কিছু হলো না।

আরও একটি বিষয় নজরে রাখা দরকার। শ্যামপুরের চেয়ে মুন্সিগঞ্জের রাসায়নিক পল্লির প্রতি ব্যবসায়ীরা এখন আগ্রহ বেশি দেখাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু পরে তাঁরা কী করবেন, এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি বাসার নিচে রাসায়নিকের গুদাম আছে।

প্রতিবার অগ্নিদুর্ঘটনার পর জানা যায়, ওই এলাকায় এমন গুদাম করার অনুমতি সরকারের কোনো কর্তৃপক্ষই দেয়নি। কিছুদিন এসব নিয়ে হইচই আলোচনা হয়। তারপর আবার যে যাঁর মতো চলতে থাকেন। নিমতলী বা চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ীদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে বাকি সবাই সাবধান হতেন।

আইনের শাসন ভঙ্গুর যে দেশে, সে দেশে পুড়ে মারা যাওয়া বা ঝলসে যাওয়া স্বজনেরা হাহাকার করবেন, আর সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে ব্যবসা চলবে, এমনটাই স্বাভাবিক। সরকার আর ব্যবসায়ী—এই দুই পক্ষের সদিচ্ছা ছাড়া এই অবস্থা থেকে মুক্তির আর কোনো পথ নেই।