বিচারবহির্ভূত হত্যা

প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হোক

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে ১ হাজার ৯২৬ মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এটি কেবল সংখ্যা নয়, প্রতিটি ঘটনার পেছনে রয়েছে একটি মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া, পরিবারের বেদনা ও কষ্টের কাহিনি।

প্রথম আলোর পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, দেশের এমন কোনো জেলা নেই, যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী রয়েছেন। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তাঁদের কেউ ছিলেন মাদক ব্যবসায়ী, দুষ্কৃতকারী কিংবা সন্ত্রাসী। 

কেউ অপরাধ করলেও এভাবে কাউকে বিচারের আগে হত্যা করা যায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় বন্দুকযুদ্ধের যেসব গল্প সাজানো হয়েছে, সেগুলো অবিশ্বাস্য। প্রায় প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে একই বিবৃতির পুনরাবৃত্তি—আসামি গ্রেপ্তার হওয়ার পর অবৈধ অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করেছেন এবং অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে আক্রান্ত হয়ে পাল্টা গুলি ছুড়লে তিনি নিহত হন।

উদ্বেগের বিষয় হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মামলা করার সাহস পেত না। কেউ কেউ আদালতে মামলা করার চেষ্টা করতে গিয়ে হয়রানি ও হুমকির শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই কমবেশি বিচারবহির্ভূত হত্যা ঘটেছে। ২০০৪ সালের মার্চে বিএনপি সরকার র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) গঠন করে। সে সময় ঢাকায় কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কথিত চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে একের পর এক ‘ক্রসফায়ারের’ নামে হত্যার ঘটনা ঘটে। এর আগে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময়েও ক্রসফায়ারে অনেকে নিহত হন; যার জন্য ওই সরকারকে জাতীয় সংসদে দায়মুক্তির আইন করতে হয়।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যে আওয়ামী লীগ বিচারবহির্ভূত হত্যা ও দায়মুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিল, তারাই ক্ষমতায় এসে নির্বিচার সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে। তাদের আমলে বিচারবহির্ভূত খুনের মাত্রা এত বেড়ে যায় যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ র‍্যাবের সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে কক্সবাজারে পুলিশের হাতে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা খুন হলে দেশের ভেতরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ দুটি ঘটনার পর বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কমে এলেও ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার হয়নি। 

বিচারবহির্ভূত খুন সব সময় রাজনৈতিক কারণে হয়েছে, তা নয়। ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারেও কথিত বন্দুকযুদ্ধ চালানো হতো। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র‍্যাবের সদস্যরা জড়িত হয়েছিলেন অবৈধ আর্থিক সুবিধা পাওয়ার আশায়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও যৌথ বাহিনীর অভিযানকালে কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এটাও বিচারবহির্ভূত হত্যা।

যে দেশে আইনের শাসন থাকে, সে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা চলতে পারে না। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেছেন, ‘আমরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের এমন কিছু প্রস্তাব দিতে চাই, যাতে আগামী দিনে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

তাঁর সদিচ্ছাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু সদিচ্ছা ও এর বাস্তবায়নের মধ্যে যে বিরাট ফারাক আছে, সেটাও সরকারকে মনে রাখতে হবে। কোনো নামেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সেই সঙ্গে এযাবৎ সংঘটিত প্রতিটি বিচারবহির্ভূত খুনের সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে, দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তাঁদের কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। সরকারের উচিত তাঁদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা।