সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকুন

১৯৯৭ সালে কার্যপ্রণালি বিধিতে পরিবর্তন এনে জাতীয় সংসদের সাধারণ সদস্যদের মধ্য থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি করার সিদ্ধান্ত ছিল খুবই ভালো উদ্যোগ। এর আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রীরাই সংসদীয় কমিটির সভাপতি হতেন, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে মানানসই নয়। মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের প্রধান। আবার তিনিই সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হলে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি আদায় করা যাবে কী করে?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরুর মাত্র পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় কমিটি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯টি কমিটি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত। বাকি ১১টি কমিটি সংসদের বিভিন্ন বিষয়-সম্পর্কিত। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাজ হলো তার আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা করা। পাশাপাশি বিভিন্ন অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগের প্রশ্ন সামনে এলে তা তদন্ত করা।

অতীতের মতো এবারও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের পদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী, এমন কোনো সদস্য সংসদীয় কমিটিতে নিযুক্ত হবেন না, যাঁর ব্যক্তিগত, আর্থিক ও প্রত্যক্ষ স্বার্থ কমিটিতে বিবেচিত হতে পারে। প্রথম আলোর পর্যালোচনায় অন্তত ছয়টি কমিটির নাম উঠে এসেছে, যেখানে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিতে পারে। এগুলো হলো যথাক্রমে বাণিজ্য, শ্রম ও কর্মসংস্থান; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; নৌপরিবহন; প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ৯ সদস্যের মধ্যে ৬ জনই পেশায় ব্যবসায়ী। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর–ই–আলম চৌধুরী অবশ্য এসব কমিটির বিষয়ে কোনো সমস্যা দেখেন না। তিনি বলেছেন, ব্যবসা অনেকের আছে, যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন। দেখতে হবে তাঁরা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করছেন কি না।

বর্তমান সংসদে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ব্যবসায়ী, সেখানে ব্যবসায়ী ছাড়া সংসদীয় কমিটি গঠন করা কঠিন। তবে ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত কমিটিতে ব্যবসায়ী সংসদ সদস্যদের না থাকাই শ্রেয়। সংসদ বিষয়ে গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত আছে, এমন কাউকে সংশ্লিষ্ট কমিটিতে না রাখলেই ভালো হতো।

নৌ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সংসদ সদস্যের নৌপরিবহন কমিটি, কিংবা তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকের শ্রম-সম্পর্কিত কমিটিতে থাকলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব অনিবার্য। তাঁদের মধ্যে অনেকের সরকারের সঙ্গেও ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। স্বার্থের সংঘাত এড়াতে সংসদ সদস্যদেরই উচিত এ বিষয়ে স্পিকার কিংবা চিফ হুইপকে আগে জানিয়ে দেওয়া।

আরেকটি সমস্যা দেখা দিয়েছে সাবেক মন্ত্রীদের সংসদীয় কমিটির সভাপতি পদে ‘পুনর্বাসন’ নিয়ে। অনেকে এটাকে সান্ত্বনা পুরস্কারও মনে করেন। সাবেক মন্ত্রীকে কমিটির সভাপতি করার যুক্তি হলো তিনি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। নেতিবাচক দিক হলো তাঁর আমলের কোনো দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ থেকে যায়।

সাবেক মন্ত্রী সংসদীয় কমিটির সভাপতি হলে একটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়াও অস্বাভাবিক নয়। আবার কোনো কোনো কমিটির সভাপতি পদে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যঁাদের ওই বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা নেই।

জাতীয় সংসদ কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গত দুই সংসদের মতো চলতি সংসদেও কার্যত বিরোধী দল বলে কিছু নেই। এসব বাস্তবতা আমলে নিয়ে স্পিকারের উচিত হবে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে, এমন সদস্যদের বাদ দিয়ে কমিটির পুনর্বিন্যাস করা।