সব ক্ষেত্রেই জবাবদিহির সংস্কৃতি চালু করুন

সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমান স্বাক্ষরিত এক বার্তায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে, যদি অতীতের মতো তা কাগুজে ঘোষণায় সীমাবদ্ধ না থাকে।

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দিতে হয়। এরপর পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম আছে। দুর্নীতি রোধ ও চাকরিজীবীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এমন নিয়ম থাকলেও এত দিন তেমন মানা হতো না। আরও অনেক কিছুর মতো এটাও ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’।

গত ১৪ আগস্ট আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার পর বিচার বিভাগীয় সব কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দেশে-বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব বিবরণী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সবাই হিসাব বিবরণী দিয়েছেন কি না, জানানো হয়নি। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক হলো। আগে যাঁরা কেবল আয়করের আওতায় ছিলেন, তাঁরাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একটি আয়কর বিবরণী দিতেন। 

২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু পরে তারা সেটি বাস্তবায়ন করেনি। এ নিয়ে সাংবাদিকেরা বিভিন্ন সময় প্রশ্ন করলে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এনবিআরে তাঁদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার দোহাই দিতেন। এটা সেই রোগ সারলে দেবতাকে জোড়া পাঁঠা দেওয়ার গল্পের মতো। রোগ সারার পর আর দেবতার কথা মনে থাকে না। আরও অনেক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মতো এটাও রক্ষা করেনি একটানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার। 

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়া সম্পর্কে জনপ্রশাসনসচিব বলেছেন, ‘এত দিন তো অনেক কথা শুনেছেন—জিরো টলারেন্স, হাতি-ঘোড়া। এসব শুনে লাভ নেই, আমি বলতেও চাই না। যেখানে যেটা করার, আমরা করতে পিছপা হব না।’ 

তাঁর এই আশ্বাসবাণী জনগণকে আশ্বস্ত করবে কি না, সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎই দেবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার পূর্বসূরিদের মতো আচরণ করবে না, এই বিশ্বাস দেশবাসীর আছে। প্রতিশ্রুতিভঙ্গের পরিণাম আমাদের সবার জানা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগকে বিদায় নিতে হয়েছে মহা দুর্নীতির দায় নিয়ে। এই সরকারের আমলেই ‘বেনজীর–কাণ্ড ’ও মতিউর–কাণ্ড’সহ বহু কেলেঙ্কারি ঘটেছে। মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। 

এই প্রেক্ষাপটে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে আশা করব, সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি উপদেষ্টাদের সম্পদেরও হিসাব দেওয়া হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যদি এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন, উত্তরসূরিরাও তাঁদের অনুসরণ করবেন। 

এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিবকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু সচিবের নেতৃত্বে এ ধরনের কমিটি গঠন না করে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন করা যেতে পারে, যাঁরা কেবল সরকারি কর্মকর্তা নন, মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের সম্পদের হিসাব নিতে পারবেন। সব ক্ষেত্রেই জবাবদিহির সংস্কৃতি চালু করা জরুরি।