সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ক্ষুধা সূচকে অবনতি

বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে কেন

শত বছর আগে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন।’ সেটা ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল। এরপর পাকিস্তানের ২৪ বছর পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স এখন ৫১ বছর। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে আমরা ক্ষুধা সূচকে খুব বেশি অগ্রগতি লাভ করতে পারিনি।

গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (জিএইচআই) বা ক্ষুধা সূচক ২০২২ অনুযায়ী, বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। গত বছর এই সূচক ছিল ৭৬তম। অপুষ্টি, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা, মৃত্যুহার, উচ্চতার তুলনায় ওজন—এই চার বিষয় সামনে রেখে তৈরি হয় বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক। বাংলাদেশে বহু মানুষ যে পুষ্টিকর ও প্রয়োজনীয় খাবার পায় না, তা জানতে গবেষণার প্রয়োজন হয় না। ঘর থেকে দুই পা ফেলে চারপাশে তাকালেই তা দেখা যায়।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে কোনো দেশ শূন্য স্কোর হলে বুঝতে হবে সেখানে ক্ষুধা নেই। আর স্কোর ১০০ হওয়ার অর্থ, সেই দেশটিতে ক্ষুধার মাত্রা সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের স্কোর ১৯.৯, গত বছর ছিল ১৯.১। এর অর্থ হলো আমরা ‘মারাত্মক ক্ষুধা’ (স্কোর ২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯) পরিস্থিতি থেকে খুব দূরে নেই। জিএইচআইএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শীর্ণকায় (উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন) ও অপুষ্টির শিকার শিশু রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়।

ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ওপরে আছে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। নিচে ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। আমরা শেষোক্ত তিনটি দেশের চেয়ে সামান্য ভালো অবস্থানে আছি বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করার সুযোগ নেই। এক বছরে কয়েক ধাপ নিচে নেমে যাওয়া অশনিসংকেতই বটে। হতে পারে ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুধা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা উত্তরাঞ্চল থেকে মঙ্গা দূর করার কৃতিত্ব দাবি করলেও নাগরিকদের একটা বড় অংশের ক্ষুধা সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। এর অর্থ এই নয় যে প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সবার আগে সরকারকে নাগরিকের মৌলিক চাহিদা, বিশেষ করে খাদ্যের জোগানের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। যদিও নীতিনির্ধারকদের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি ও প্রকল্পের বহর দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা খাদ্যের চাহিদা মেটানোর বিষয়টিকে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন না। আর দিলেও গরিবের হক সুবিধাভোগীরা মেরে দেয়।

করোনা মহামারির সময়ে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছিল সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে। মহামারি চলে যাওয়ায় সরবরাহব্যবস্থা এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। কিন্তু খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার জন্য খাদ্য পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে। গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে বাজারে খাদ্য থাকলেও দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে তা কিনে খাওয়া সম্ভব হয় না। এ কারণেই আমরা টিসিবির দোকান ও ট্রাকের সামনে নারী-পুরুষের লম্বা লাইন দেখি।

অতএব, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা বিদেশে চাল রপ্তানি করছি, এ ধরনের বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে অধিক খাদ্য ফলানো কিংবা অধিক আমদানি করলেই ক্ষুধা সমস্যার সমাধান হবে না। খাদ্য ক্রয়ে নাগরিকদের সামর্থ্য বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।