সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ভূমিহীন ও গৃহহীন বিশ্ববিদ্যালয়

কবে নাগাদ তারা নিজস্ব ক্যাম্পাস পাবে

সরকার নানা রকম চাপ দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে বাধ্য করেছে, এটা ইতিবাচক। ইউজিসির আইনেও প্রতিষ্ঠার সাত বছরের মধ্যে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সেই বাধ্যবাধকতা কিংবা ইউজিসির তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর চলছে ভাড়াবাড়িতে কিংবা স্কুল–কলেজের ভবনে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, নিজস্ব ক্যাম্পাসহীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৮, যার বেশির ভাগই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ডিজিটাল এবং কৃষিশিক্ষার মতো বিশেষায়িত। সরকার ২০১৩ সাল ও এরপর বিভিন্ন বছরে এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইন করেছে। শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে, কিন্তু সব কটির স্থায়ী ক্যাম্পাসের ব্যবস্থা হয়নি। তিনটির স্থায়ী ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ চললেও বাকিগুলো অনিশ্চিত। ১৪টির জমিই নেই, ভবন হবে কী করে?

৮ মে প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, তবু ভূমিহীন, গৃহহীন।’ প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সরেজমিন ঘুরে যে চিত্র দেখা গেছে, তা খুবই হতাশাজনক। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম চলে এক ভাড়াবাড়িতে, শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে সেখান থেকে দূরবর্তী এক বা একাধিক ভাড়াবাড়িতে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে। আবাসনের ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীদের মেসে থাকতে হয় উচ্চ ভাড়া দিয়ে।

কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বছরের পর বছর এভাবে চলছে। প্রতিষ্ঠার জন্য ২০১৬ সালে আইন হওয়া রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণই করা হয়নি। একই অবস্থা খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েরও। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালে। বর্তমানে কয়েকটি ভাড়া করা বাড়িতে প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, তা–ও কাছাকাছি স্থানে নয়। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই মেয়াদ শেষে প্রথম উপাচার্য বিদায় নিয়েছেন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে। অন্যদিকে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব জমি পেলেও ভবন তৈরি হয়নি। ভাড়াবাড়িই ভরসা।

উল্লিখিত তিনটিসহ যে ১৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়াবাড়িতে চলছে, সেগুলো কবে নাগাদ নিজস্ব ক্যাম্পাস পাবে, তা কেউ বলতে পারছে না। আমাদের শিক্ষার অভিভাবকেরা নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা এবং যেনতেন প্রকারে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেই দায়িত্ব শেষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও ভবন নির্মাণের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে, তার জোগান কোথা থেকে আসবে, তা–ও স্পষ্ট নয়।

সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে পরিকল্পনা করেছে, তার সঙ্গে অনেক শিক্ষাবিদই একমত নন। তাঁদের মতে, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেয়েও জরুরি হলো প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভিতকে আরও শক্তিশালী করা। একই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষা নিয়ে এন্তার অভিযোগ আছে। নতুন প্রজন্মের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান তার থেকে খুব একটা এগিয়ে আছে, বলা যাবে না। কীভাবে থাকবে, সেখানে অভিজ্ঞ ও মেধাবী শিক্ষক নেই, অবকাঠামো নেই, নেই শিক্ষার অপরিহার্য উপকরণও। এমনিতেই বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যে ধরনের চাহিদা আছে, সেই জনবল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জোগান দিতে পারছে না।

আমরা আশা করতে চাই, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পথনকশা দেওয়া হবে এবং তার বাস্তবায়নে যথাযথ ও টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

‘গৃহহীন ও ভূমিহীন’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অপবাদ যত দ্রুত ঘুচবে, ততই মঙ্গল।