সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

শ্রীহীন প্রাথমিক বিদ্যালয়

শিক্ষাকে টেকসই বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রে স্থান ও বিদ্যালয়ভেদে সুযোগ-সুবিধার প্রকট বৈষম্য, অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষকস্বল্পতাসহ সমস্যাগুলো দূর করে শিক্ষার ভিত শক্ত করা হবে।

কিন্তু প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার দিকে তাকালে শিক্ষানীতি আর বাস্তবতা—দুটি যে দুই পথে চলছে, তা বলাটা অত্যুক্তি হবে না। বনিয়াদি শিক্ষার একেবারে শুরুর স্তরে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত যেখানে গড়ে তোলা হয়, সেখানকার ভিত্তিটাই যদি নড়বড়ে থেকে যায়, তাহলে দেশের টেকসই উন্নয়ন কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব?

গত ৫ মে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর দুরবস্থার ছবি বেরিয়ে আসে। ঢাকার ৩৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪০টি বিদ্যালয়ে সরেজমিনে পাওয়া যায়, বিদ্যালয়গুলোর ভবনগুলো মলিন ও অপরিচ্ছন্ন। শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক কম। বিদ্যালয়গুলোতে সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত দপ্তরি, নিরাপত্তা প্রহরী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও আয়া নেই। বেশ কিছু বিদ্যালয়ের জমি ও অবকাঠামো বেদখল হয়ে আছে। সহশিক্ষা কার্যক্রম নেই, শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

খোদ রাজধানীতেই প্রাথমিক শিক্ষার এই দীনহীন অবস্থার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? এসব বিদ্যালয়ে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা পড়ে বলেই কি কর্তৃপক্ষ এমন উদাসীন? শিক্ষাবিদেরা মনে করেন, দেশে প্রচুর বেসরকারি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের সন্তানদের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ান না। এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি কি ঘোষিত শিক্ষানীতির ‘সর্বজনীন’ এবং ‘সবার জন্য একই মানের’ শিক্ষা নিশ্চিতের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না।

রাজধানীরই যখন এই অবস্থা, তখন সারা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার কী হাল, সেটি সহজেই অনুমেয়। সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সমীক্ষাতেই বেরিয়ে এসেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষার মানের কী তথৈবচ অবস্থা। ১০টি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সহযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষা সম্প্রসারণের মূল কার্যক্রম হিসেবে তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৩) বাস্তবায়ন করেছে সরকার। ২০১১ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি দুই দফা সংশোধন করে শেষ হয় ২০১৮ সালে।

প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির প্রভাব মূল্যায়নে আইএমডিবির সমীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় ২৭ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয় জরাজীর্ণ এবং ১৯ শতাংশ শ্রেণিকক্ষে বৃষ্টি হলেই পানি ঝরে। টিউবওয়েল নেই ১৩ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, টিউবওয়েল নষ্ট ১৩ শতাংশ বিদ্যালয়ে। পৃথক শৌচাগার নেই ২৫ শতাংশ বিদ্যালয়ে। সমীক্ষায় শিক্ষার মানেরও একটি চিত্র পাওয়া যায়। প্রাথমিকের ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য গাইড বইয়ের ওপর তাদের নির্ভরতার কথা জানিয়েছে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেসকো) পরামর্শ হলো শিক্ষায় জিডিপির ৬ শতাংশ ব্যয় করা প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমরা অতিকৃপণতার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি; বরং সর্বশেষ বাজেটে জিডিপি অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমেছে। শিক্ষায় এত কম বরাদ্দ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কিংবা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা বলা ‘সোনার পাথরবাটির’ মতোই অলীক কল্পনা।

সারা বিশ্বে শিক্ষা যেখানে সবচেয়ে টেকসই বিনিয়োগ হিসেবে স্বীকৃত, সেখানে আমরা এখন পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার ভিতটাই শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে পারিনি। দেশে মেগা প্রকল্পসহ চোখধাঁধানো অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিপরীতে জরাজীর্ণ ভবনে এবং অনুদার পরিবেশে প্রাথমিকে শিক্ষাদানের চিত্র নিশ্চিতভাবেই সাংঘর্ষিক।

প্রাথমিক শিক্ষাকে এই শ্রীহীনতার বৃত্ত থেকে বের করে নিয়ে আসা প্রয়োজন। সবার আগে চাই রাজনৈতিক অঙ্গীকার। সর্বজনীন শিক্ষাকে বোঝা নয়, টেকসই বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে।