জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিউইয়র্ক সফরটি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরুর পর সংস্কার ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রশ্নে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার ১২টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি—সবটা মিলিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সফরে বিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক স্বীকৃতির ইঙ্গিত মিলেছে।
জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক পৌঁছান। এরপরের দিনই জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সভাকক্ষে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠক বিরল। প্রথা ভেঙে এ বৈঠকে বাইডেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়ে বাংলাদেশের সংস্কারে সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানান। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বৈঠকেও সংস্কার ও সুষ্ঠু নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে বলে জানানো হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ও প্রবাসী আয়ের মূল উৎস যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে যে ইতিবাচক উত্তরণ ঘটেছে, বাইডেন ও ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফলপ্রসূ বৈঠক তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেনও পৃথক বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেছেন।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচনার আহ্বান জানান। বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার আগ্রহের কথা জানায় চীন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠকে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার আশাবাদ প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও নেপালের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠককে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে ধরা যায়।
দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তলানিতে গিয়ে পৌঁছে। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভিন্নমত দমন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহায়তার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উত্তরণ ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম এ এ খানের বৈঠকটি জুলাই-আগস্টের গণহত্যার বিচারের ক্ষেত্রে একটি নতুন পথ খোলার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেও প্রধান উপদেষ্টার সফর উল্লেখযোগ্য এক অগ্রগতি বলে বিবেচিত হবে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা বাংলাদেশকে ৩৫০ কোটি ঋণসহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন, যার ২০০ কোটি ডলার নতুন ঋণ। আইএমএফের সঙ্গেও ৩০০ কোটি ডলারের নতুন ঋণের ব্যাপারে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, টেকসই সংস্কারের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র, সুশাসন ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিশ্বকে পাশে চায় বাংলাদেশ। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলার যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সব মিলিয়ে প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ মিশন বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করল।