ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও পুরাকীর্তির মধ্যে জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের লুকানো অনেক উপাদান থাকে। এসব সম্পদ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে তাদের পূর্বসূরিদের একটা সেতুবন্ধ তৈরি করে দেয়। এ কারণে সব রাষ্ট্রই এসব মূল্যবান সম্পদ সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা আমাদের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা চিরকালই উদাসীন।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, সংরক্ষণের দুর্বলতা ও স্থানের সংকটে জাতীয় জাদুঘরের ৮৯ হাজার নিদর্শন ক্ষতির মুখে। এ খবর আমাদের যারপরনাই উদ্বিগ্ন করে। কেননা ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেভাবে ভ্যাপসা গুদামে সংরক্ষণ করে রাখা, সেটা পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক। অধিকাংশ গুদামঘর ভবনের নিচতলায়। এগুলোর জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে তাপনিয়ন্ত্রণের যন্ত্র নেই। প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাপ, আর্দ্রতা, আলো গুরুত্বপূর্ণ। দলিল কিংবা ধাতব বস্তু কিংবা চিত্রকর্ম সংরক্ষণের জন্য আলাদা পরিবেশ দরকার, যেখানে তাপ, আর্দ্রতা ও আলোর মাত্রা নির্দিষ্ট থাকতে হবে। এসবের মাপ যথাযথ না থাকলে প্রত্নসামগ্রীতে পরিবর্তন শুরু হয়, ক্ষয় হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এটি বোঝা না গেলেও বড় সময়ের ব্যবধানে স্পষ্ট হয় ক্ষতি।
জাতীয় জাদুঘরে ৯৪ হাজারের বেশি নিদর্শন আছে। ৫ শতাংশ থাকে প্রদর্শনের জন্য। বাকি সব থাকে ৪০ বছর আগে নির্মিত ভবনের বিভিন্ন স্টোররুম বা গুদামঘরে। এ গুদামঘরগুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষই সন্তুষ্ট নয়। জাদুঘরের সংরক্ষণ রসায়নাগার বিভাগ বলছে, তাদের পক্ষে যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ চেষ্টা করে প্রত্নবস্তু সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তবে তা যথেষ্ট নয়।
জাদুঘর কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন ভবন নির্মিত হলে সংকটের সমাধান হবে। ২০১৮ সালে পরিকল্পনা নেওয়া হলেও জাদুঘরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আপত্তির কারণে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। কেননা নতুন ভবন হলে তঁাদের আবাসন ভাঙা পড়বে। প্রশ্ন হচ্ছে, জাদুঘরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যখানে আবাসনের ব্যবস্থা করে সেখানে প্রস্তাবিত ভবন নির্মাণ করতে কেন দেরি হবে? যেখানে দুই হাজার বছরের পুরোনো প্রত্নসম্পদ ঝুঁকির মুখে, সেখানে কেন এই দীর্ঘসূত্রতা?
জাদুঘরে প্রত্নবস্তু সংরক্ষণে সংরক্ষণব্যবস্থা তৈরি হয়নি বলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর যে মন্তব্য করেছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। ইতিহাসের মহামূল্যবান নিদর্শন ও প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণে উদাসীনতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাদুঘরের পরিচালনা কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে, প্রয়োজনে বাইরের বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া উচিত।