স্যার রোনাল্ড রস শেষ বয়সে দুঃখ করে লিখেছিলেন, ম্যালেরিয়ার ওপর গবেষণার জন্য তাঁকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাঁর নামে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে, সম্মান-সমাদরের কমতি নেই; শুধু মশা তাড়ানোর জন্য তিনি যা যা করতে বলেছেন, তার কিছুই করা হয়নি।
কীটতত্ত্ববিদেরা অনেকবার ঢাকা শহরের মশার ঘনত্ব বৃদ্ধির চিত্রসংবলিত প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। কিন্তু মশা নিধনে যথার্থ ব্যবস্থা না নেওয়ায় সম্প্রতি ডেঙ্গু জ্বরের যে প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে, তা রোনাল্ড রসের সেই আক্ষেপকে ফের মনে করিয়ে দিচ্ছে।
চলতি বছরের ২৪ নভেম্বর (গত রোববার) পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের পরিসংখ্যান জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় সংকেত। গত শনিবার থেকে রোববার ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এক দিনে সর্বোচ্চ। একই সময়ে ১ হাজার ৭৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট ৪৫৯ জনের মৃত্যু এবং ৮৬ হাজার ৭৯১ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া স্বাস্থ্য খাতের চরম দুর্বলতা ও পূর্বপ্রস্তুতির অভাবকেই স্পষ্ট করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বর্তমান অবস্থা জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সরকারের পদক্ষেপ এখনো গতানুগতিক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট। যথাসময়ে এডিস মশার প্রজনন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, যা এই সংকটকে আরও তীব্র করেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২১-২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণ বেশি হলেও ২৬-৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুহার সর্বোচ্চ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার পরিস্থিতি সবচেয়ে করুণ, বিশেষত ঢাকা দক্ষিণে। এখানকার হাসপাতালগুলোতে এ বছর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গু শনাক্তকরণে ঘাটতি এবং চিকিৎসার বিলম্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। রোগীদের শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে, যা দ্রুত মৃত্যুর কারণ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো ছাড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এটি কোনো এক বছরের সমস্যা নয়। গত বছর ডেঙ্গুতে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন আক্রান্ত হন এবং ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়। অথচ সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বছর কার্যকর প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। বর্তমান সংকট কেবল এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার ফল নয়; এটি সমন্বয়হীন ব্যবস্থাপনা ও যথাসময়ে পদক্ষেপ নিতে না পারার উদাহরণ।
ডেঙ্গুর মতো একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগে এভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। জনসচেতনতা বাড়ানো, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামোগত উন্নয়ন এবং সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকারের কার্যকর সমন্বয় ছাড়া এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।
মশা মারতে বছরে বছরে ঢাকা উত্তর (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ (ডিএসসিসি) দুই সিটি করপোরেশন ক্রমান্বয়ে যেভাবে বাজেট বাড়িয়ে থাকে, তা দিয়ে ‘কামান দাগানো’ও সম্ভব। দফায় দফায় মশা মারার ওষুধ পাল্টানো হয়, ওষুধ আমদানিতে টেন্ডারও হয়। কাজের কাজ কিছুই হয় না।
বিশেষজ্ঞ মত হলো, প্রধানত কিউলেক্স মশা বৃদ্ধির মূল উৎস বদ্ধ জলাধার ও নর্দমা। আর ডেঙ্গু ছড়ানো এডিস মশার উৎস বাসাবাড়িতে নির্মাণাধীন উন্মুক্ত আধার ও পরিষ্কার পানি। এই প্রজননস্থল ও ‘আঁতুড়ঘর’ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে মশার বংশবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরা সম্ভব হতো। এর জন্য অনিবার্যভাবেই দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। অন্যথায় ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ রূপ নিয়ে ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।