সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনা

কী কৈফিয়ত দেবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ

পৃথিবীর সব দেশেই রেলপথকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সাশ্রয়ী পরিবহন হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে ঘন ঘন ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে, তাতে এটিকে আর নিরাপদ পরিবহন বলা যায় না। বেশির ভাগ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে লাইনচ্যুত হয়ে কিংবা রেলক্রসিং খোলা থাকার কারণে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা কম। কিন্তু চালক যখন সংকেত অমান্য করে চালাতে থাকেন, তখন দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে সেটি ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

গত সোমবার ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে যে দুর্ঘটনা ঘটে, তারও কারণ মালবাহী ট্রেনটির চালকের সংকেত না মানা। ফলে এগারসিন্দুর ট্রেনটির পেছনের তিনটি কোচে মালবাহী ট্রেনটি ধাক্কা দেয়। এতে যাত্রীবাহী ট্রেনের পেছনের দুটি কোচ উল্টে গিয়ে ১৮ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হন।

দুর্ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জ—তিন পথে সাড়ে সাত ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। রেলের পূর্বাঞ্চলের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা (জিএম) নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, চালক সংকেত না মেনেই চলে এসেছেন বলে মনে হয়েছে।

বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০১৮ সাল থেকে ট্রেন দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৩০২ জন। এ সময় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে ১ হাজার ১১৬টি।

রেলওয়ের কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে, এগারসিন্দুর ট্রেনটি ভৈরব রেলস্টেশন থেকে ঢাকার পথে আসছিল। আর মালবাহী ট্রেনটি ভৈরব স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। দুর্ঘটনার সময় এগারসিন্দুর ট্রেনটি এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যাচ্ছিল। এগারসিন্দুর ট্রেনটি লাইন পরিবর্তনের জায়গা অতিক্রম করে ১১টি কোচ পার হয়ে যায়। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রেনটি এগারসিন্দুরের শেষ তিন কোচে আঘাত করে।

রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটেছে ভৈরব স্টেশনের বাইরে, যেখানে একাধিক লাইনের জোড়া রয়েছে। এখানে ট্রেন এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যায়। ফলে দুটি ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কাও ছিল। এতে আরও বড় বিপর্যয় হতে পারত। ১৮ জন মানুষের মৃত্যু হওয়া কি বড় বিপর্যয় নয়?

অতীতের মতো এবারও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একাধিক তদন্ত কমিটি করেছে। মালবাহী ট্রেনের চালক ও সহকারী চালককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি যথাসময়ে প্রতিবেদনও হয়তো দেবে। কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা সমুচিত শাস্তি পাবেন, এই নিশ্চয়তা নেই। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ রেলওয়েও চলছে স্বেচ্ছাচারী কায়দায়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা অমার্জনীয়।

রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ের চালকেরা তো বেশি প্রশিক্ষিত হয়ে থাকেন। তারপরও এ ধরনের নির্দেশ বা সংকেত না মানার কী কারণ থাকতে পারে? এত দিন আমরা বাসচালকদের বেপরোয়া চালানোর কথা শুনে এসেছি। এবার ট্রেনচালকও সেই কাণ্ড করলেন। যে চালক সংকেত উপেক্ষা করে ট্রেনের যাত্রীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন, তঁাকে শাস্তির আওতায় আনতেই হবে।

 এই যে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৮টি প্রাণ ঝরে গেল, বিপুল সম্পদ নষ্ট হলো—তার দায় কে নেবে? আইন অনুযায়ী রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কিছু ক্ষতিপূরণ হয়তো দেবে। কিন্তু মানুষের জীবনের তো কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। যাঁরা তঁাদের স্বজন ও প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাঁদের কাছে কী কৈফিয়ত দেবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ?