ছাত্রলীগের কাছে অসহায় উপাচার্যও

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য যখন সবকিছু দেখেশুনে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, ক্যাম্পাসে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি কতটা বেপরোয়া। 

বাংলাদেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে ছাত্রলীগ একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তা থেকে ভিন্ন নয়। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যে অসহায় প্রশাসন। গত দুই বছরে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থী ও সাংবাদিক নির্যাতনের অন্তত পাঁচটি অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাৎক্ষণিক তদন্ত কমিটি গঠন করলেও পরে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। 

ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি। তদন্তের পর তদন্ত করে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম রিজেন্ট বোর্ডে দুই দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেও পাস করাতে পারিনি। রাজনৈতিক কারণে আমি অসহায়।’ 

একজন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের এই স্বীকারোক্তি উচ্চশিক্ষাঙ্গনের লজ্জাকর চিত্রই তুলে ধরে। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই প্রধান ও অভিভাবক। অভিযোগ আছে, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো ঘটনা ঘটলে রিজেন্ট বোর্ড ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। কিন্তু কাজী নাবিল আহমেদ সেই বোর্ডের সদস্য হিসেবে ছাত্রলীগের কোনো নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব এলেই এর বিরোধিতা করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। 

এ বিষয়ে সংসদ সদস্য যে যুক্তি দেখাচ্ছেন, সেটাও হাস্যকর। তিনি বলেছেন, ‘এর আগে কিছু ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।’ অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন যে অতীতের ঘটনার বিচার না হলে বর্তমানে সংঘটিত অঘটনেরও বিচার করা যাবে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্টুডেন্ট কোড অব কন্ডাক্ট’ অনুযায়ী ক্যাম্পাসে সব ধরনের রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ; কিন্তু ২০১৪ সালের মে মাসে ছাত্রলীগ সেই নিয়ম ভেঙে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। ২০২২ সালের ৩১ জুলাই মো. সোহেল রানাকে সভাপতি ও তানভীর ফয়সালকে সাধারণ সম্পাদক করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ১১ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এই ১১ জনের মধ্যে সভাপতিসহ ৭ জনেরই বর্তমানে ছাত্রত্ব নেই বলে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়। 

গত বছরের ৭ ডিসেম্বর লিফট অপারেটর পদে চাকরির পরীক্ষা দিতে ক্যাম্পাসে এসে ১১ প্রার্থী ছাত্রলীগের নির্যাতন–নিপীড়নের শিকার হন। ওই দিন মসিয়ূর রহমান ছাত্র হলে তাঁদের পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করে পরে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুই দফায় তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির তদন্তে ছয় শিক্ষার্থীর জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে। 

সর্বশেষ ৪ জুন গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মসিয়ূর রহমান আবাসিক হলের শিক্ষার্থী শাহরীন রহমানকে ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানার কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে রাতভর তাঁকে রড ও লাঠি দিয়ে পেটানো হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু কোনো ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

ছাত্রলীগের নেতা হোন বা অন্য কেউ, ছাত্রত্ব না থাকলে তাঁদের ক্যাম্পাসে থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু ছাত্রত্ব শেষ হওয়া ছাত্রলীগ নেতারা বহাল তবিয়তে ক্যাম্পাসে আছেন এবং মাঝেমধ্যেই অঘটন ঘটাচ্ছেন। এভাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেখানে উপাচার্য তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তৃত্ব থাকবে, নাকি ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ইজারা দেওয়া হবে?