সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বয়স্ক ভাতা পেতে উৎকোচ

দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনুন

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জরিপে বয়স্ক ভাতা নিয়ে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা বিচলিত হওয়ার মতো। বয়স্ক ভাতার কার্ড পেতে একেকজন সুবিধাভোগীকে গড়ে ২ হাজার ৬৫৩ টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। মাসে তাঁরা ভাতা পান ৫০০ টাকা। ২ হাজার ৬৫৩ টাকা ঘুষ দিতে হলে কত মাসের ভাতার টাকা যায়, অনুমান করা কঠিন নয়।

জরিপে দেখা যায়, স্থানীয় পর্যায়ে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কার্ড করতে গিয়ে একজন উপকারভোগীকে সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। আর এসব ঘুষ নিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও সরকারের কর্মকর্তারা। সিপিডি পরিচালিত জরিপে দেশের ২৯টি উপজেলার ৪৮৬ জন বয়স্ক ও বিধবা ভাতার সুবিধাভোগীর মতামত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন ১০৮ জন বয়স্ক, ২০০ জন বিধবা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ১৭৮ জন অভিভাবক।

জরিপের ফলাফল তুলে ধরে অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত অনেকে ভাতা পাচ্ছেন না। আবার ভাতার দরকার নেই, এমন অনেকে নিয়মিত ভাতা নিচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ৩৩ লাখ বয়স্ক ও ২৫ লাখ বিধবা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভাতা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে, প্রায় ৩০ শতাংশ বয়স্ক ও ৩৩ শতাংশ বিধবা ভাতা পাওয়ার অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। এতে তাঁদের পেছনে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এ টাকা দিয়ে প্রায় ১৫ লাখ বয়স্ক ও বিধবাকে ভাতার আওতায় আনা সম্ভব।

বর্তমানে অধিকাংশ সরকারি ভাতা মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) মাধ্যমে দেওয়া হয়। কিন্তু জরিপে উঠে এসেছে, বয়স্ক ভাতাপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৭ শতাংশের কোনো এমএফএস হিসাব নেই, বিধবাদের ক্ষেত্রে তা ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া ৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রাথমিকের শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে উপবৃত্তি পায় না বলেও জরিপে উঠে এসেছে।

এর অর্থ হলো প্রতিটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে অনিয়ম ও দুর্নীতি গেড়ে বসেছে। উপকারভোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দুর্বলতার কথা স্বীকারও করেছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক মো. মোক্তার হোসেনও। কিন্তু যেসব জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা গরিবের হক কেড়ে নেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই বললেই চলে। স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন যখন নির্দলীয়ভাবে হতো, তখন সেখানে ক্ষমতার কিছুটা ভারসাম্য থাকত। ফলে দরিদ্র নারী-পুরুষদের তালিকা তৈরিতে কিছুটা হলেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকত।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক যখন জানেন যে তালিকা তৈরিতে দুর্বলতা আছে, সেটি দূর করার দায়িত্বও তাঁদেরই। নীতিমালা অনুযায়ী যাঁরা ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত নন, তাঁদের কাউকে তালিকাভুক্ত করা হলে নাম বাদ দিতে হবে।

অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয় ৫৭ লাখ ১ হাজার নারী-পুরুষকে। আগামী বাজেটে ভাতাভোগীর সংখ্যা এক লাখ বাড়ানো হবে। সরকার আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা এবং বিধবা ভাতা ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা করার চিন্তা করেছে।

এটা খুবই ভালো চিন্তা। সেই সঙ্গে বয়স্ক ও বিধবাদের তালিকা তৈরির নামে যাঁরা প্রকৃত গরিব ও দুস্থ ব্যক্তিদের হক মেরে খান, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন।