সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

নিরীহ শিক্ষার্থীরা মার খেতেই থাকবেন?

মুকুল আহমেদ নামের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা, তিনি এখন হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। ছাত্রলীগ নামধারী কয়েকজন শিক্ষার্থী গত বৃহস্পতিবার রাতে তাঁকে নির্যাতন করে হাত ভেঙে দিয়ে বাইরে থেকে কক্ষে তালা লাগিয়ে যান।

পরদিন শুক্রবার তাঁকে উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে অর্থোপেডিক ইউনিটে চিকিৎসাধীন।

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিদ ওরফে মঞ্জু ও সিহাব উদ্দিন এই নির্যাতন চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে তাঁদের বিরুদ্ধে মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মী আয়াত উল্লাহকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে গুরুতর জখম এবং পায়ের রগ কেটে পঙ্গু করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

মুকুলকে নির্যাতনের কারণ, তিনি ফেসবুকে র‍্যাগিংয়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। মুকুল তাঁর মেসেঞ্জার বার্তায় লেখেন, ‘আমাদের ব্যাচের নামে ছোট ভাইদের ডাকা হয়েছে, অথচ আমরা জানি না। আগেও এভাবে ডেকে র‌্যাগিং করা হয়েছে অনেককে। তখন বিভাগের শিক্ষকদের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। এখন আবার ডাকা হয়েছে, আমরা জানি না, এটা বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই না।’

এই বার্তার পর কথিত ছাত্রলীগ নেতা মঞ্জু ও সিহাব বঙ্গবন্ধু হলের একটি কক্ষে মুকুলকে নিয়ে গিয়ে তাঁকে শিবির আখ্যা দিয়ে কিলঘুষি, লাথি মারেন এবং জিআই পাইপ ও কাঠের চেয়ারের ভাঙা হাতল দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেন। একপর্যায়ে জ্ঞান হারালে দিবাগত রাত তিনটার দিকে ওই কক্ষে ফেলে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে তাঁরা চলে যান।

হাসপাতালের শয্যায় তীব্র যন্ত্রণায় কাতর মুকুল বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি না। আমি দরিদ্র মা-বাবার স্বপ্নপূরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। তারা আমাকে মেরে পঙ্গু করে দিল।’ নির্যাতনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তিনি। অভিযোগ পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ৪০১৮ নম্বর কক্ষটি সিলগালা করে দেয়। নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেতারা সেটি অবৈধভাবে দখল করেছিলেন এবং অঘোষিত টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে আসন পাচ্ছেন না, সেখানে কীভাবে অবৈধভাবে কক্ষ দখল করে থাকেন ছাত্রলীগ নেতারা?

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকলেও বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘাত লেগেই আছে। এক গ্রুপ সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ ও অপর গ্রুপ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের অনুসারী। এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে সাদিক আবদুল্লাহর একচ্ছত্র আধিপত্য চলছিল। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবং প্রতিপক্ষ গ্রুপ শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

আক্রান্ত মুকুল লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ নির্যাতন সেল হিসেবে পরিচিত কক্ষটি তালাবদ্ধ করে দায়িত্ব শেষ করেছে। আগস্টে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। ছাত্রলীগের নামে ক্যাম্পাসে কারা সন্ত্রাসী কাণ্ড ঘটাচ্ছে, তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অজানা নয়। তারপরও তারা নির্বিকার। তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলতে থাকবে, আর নিরীহ শিক্ষার্থীরা মার খেতেই থাকবেন?

শুধু বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সাম্প্রতিক সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। সেখানে কাউকেই পরোয়া করছে না সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনটি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও একের পর এক অপকর্মের সঙ্গে নাম আসছে ছাত্রলীগের।

নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি ও র‍্যাগিং চালিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছেন না সংগঠনটির নেতা–কর্মীরা, সাংবাদিককে মারধর করতেও বেপরোয়া তঁারা। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট কার্যকর নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রলীগের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে। আমরা এমন পরিস্থিতির অবসান চাই।