সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

কারখানা বন্ধ করে দাবি পূরণ নয়

বাংলাদেশের অর্থনীতির তিন প্রধান চালিকা শক্তির একটি তৈরি পোশাকশিল্প। যেকোনো কারখানায় বেতন–ভাতা নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ থাকতে পারে এবং সেটা আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। শ্রমিক অসন্তোষ ও বহিরাগতদের হামলার কারণে কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, সেটা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে তৈরি পোশাক, ওষুধ, খাদ্যসহ বিভিন্ন শিল্পের শতাধিক কারখানার উৎপাদন বন্ধ ছিল সোমবার। বিক্ষোভ শুরুর পর আশুলিয়ায় ৪০টি ও গাজীপুরে ৪৫টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। এর বাইরে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি কারখানা বন্ধ ছিল। গাজীপুরে ১১টি তৈরি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর হয়েছে। দুটি কারখানায় লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে।

এই প্রেক্ষাপটে গতকাল দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে তাঁর প্রতি অনুরোধ জানান। শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আশ্বস্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা। একই সঙ্গে তিনি যেসব কারখানার ভেতরে শ্রমিকেরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন, আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধানের পরামর্শ দেন ব্যবসায়ীদের।

এর আগের দিন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকেও ব্যবসায়ীরা শিল্পের নিরাপত্তায় শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। সোমবার রাত থেকেই যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য হলো, কারখানার ভেতরে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করলে সেটা আলোচনার মাধ্যমে মেটানো যায়। কিন্তু বহিরাগতরা এসে হামলা চালালে কিংবা বাইরে থেকে ভেতরের শ্রমিকদের উসকানি দিলে সেটা সহজে সমাধান করা যায় না। ব্যবসায়ী নেতারা বহিরাগতদের হামলা–উৎপাতকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রাজনৈতিক পালাবদলের সুযোগ নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন সময়েই এটা ঘটেছে।

এ ক্ষেত্রে কারখানার ভেতরে কাউকে না পেলে তাঁরা সুবিধা করতে পারবে না। কারখানার বাইরে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের কেউ কেউ দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাঁদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হলেও কিছু বলতে পারেননি। এ রকম যদি হয়ে থাকে, সেটাও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে, কারখানা ভাঙচুর বা হামলা করে নয়। তবে বহিরাগতদের পক্ষ থেকে কারখানায় নারী-পুরুষ শ্রমিকের সমতার যে দাবি জানানো হয়েছে, সেটা অগ্রহণযোগ্য। তাঁদের মনে রাখতে হবে, তৈরি পোশাকশিল্প গড়েই উঠেছে নারী শ্রমিকদের শ্রমের ওপর নির্ভর করে। নারীর ক্ষমতায়নে এই শিল্পের বিরাট ভূমিকা আছে। এখন যদি কেউ সমতার প্রশ্ন তুলে সেই ক্ষমতা খর্ব করতে চায়, বুঝতে হবে এর পেছনে দুরভিসন্ধি আছে।

যৌথ অভিযান শুরুর পর শিল্পাঞ্চলের পরিবেশ অনেকটা শান্ত হয়ে আসছে। সোমবার বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রায় সব কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। দু–একটি কারখানায় বেতন–ভাতা নিয়ে যে সমস্যা আছে, তা–ও আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করা হোক। কারখানার শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টি অনেকটা সংক্রমণের মতো। এক কারখানার শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে অন্য কারখানায়ও ছড়িয়ে পড়ে।

সবার আগে শিল্পের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। কারখানা চালু রেখেই শ্রমিকদের দাবিদাওয়া আদায় করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকারের প্রতি মালিকদেরও সংবেদনশীল হতে হবে।