সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে কবে

ডলার-ঘাটতির কারণে জ্বালানিসংকটে যখন সক্ষমতা থাকার পরও প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব না হওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে এবং শিল্পকারখানাগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, সে সময় ভোলায় নতুন কূপে গ্যাস পাওয়ার খবর দিল তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স।

গত শুক্রবার সকালে ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা-১ কূপের মুখে আগুন দিয়ে গ্যাসের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরীক্ষা সম্পন্ন করে বাপেক্স। এ কূপের গ্যাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এবং কূপটি গ্যাস উত্তোলনের উপযোগী হতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। দ্বীপজেলা ভোলায় নতুন আরেকটি গ্যাসকূপের সন্ধান পাওয়ার খবরটি নিঃসন্দেহে স্বস্তির ও আশাজাগানিয়া।

বাপেক্স সূত্রকে উদ্ধৃত করে প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির নকশা ও নির্দেশনায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার গাজপ্রম কূপটির খননকাজ পরিচালনা করছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, নতুন আবিষ্কৃত কূপটিতে ১৮০-২০০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস মজুত থাকতে পারে। উৎপাদনে গেলে কূপটি থেকে প্রতিদিন ২০-২২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। ইলিশা ১-সহ এ নিয়ে ভোলায় মোট ৯টি কূপে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেল। ভূতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, এই দ্বীপজেলায় আরও গ্যাসকূপ আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সেগুলো খুব দ্রুত অনুসন্ধান করা জরুরি।

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে গ্যাসের জন্য সম্ভাবনাময় হওয়ার পরও দেশে গড়ে প্রতিবছর মাত্র একটি কূপ অনুসন্ধান করা হয়। গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এমন দেশের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের এ হার বিশ্বে ন্যূনতম। অথচ সীমিত সম্পদ ও জনবলের সংকট নিয়েও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স দারুণ সাফল্য দেখিয়ে আসছে।

কিন্তু ভুল জ্বালানি নীতি এবং গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে অবহেলা ও দুর্বল উদ্যোগের কারণে দেশীয় গ্যাস সম্পদ পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। বরং দিনে দিনে আমদানিনির্ভর উচ্চ মূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা যেমন ঝুঁকিতে পড়ছে, তেমনি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের ভুল নীতি খোলাসা হয়ে পড়ে। সংকটে পড়ে দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের পদক্ষেপ নেয় সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ভোলার ইলিশা-১ গ্যাসকূপটির সন্ধান মিলল। কিন্তু ভোলার গ্যাস নিয়ে আড়াই দশক পরও কার্যকর পরিকল্পনা নিতে পারেনি সরকার। এ গ্যাস জেলার বাইরে আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। জেলার ভেতরেও উৎপাদন সক্ষমতা অনুসারে গ্যাসের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি।

উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানির কারণে যে ডলার ব্যয় হচ্ছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য বিষফোড়া—এমনটাই মনে করেন ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম। এ বাস্তবতায় ভোলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার নতুন করে আশাবাদ তৈরি করছে। তিনি বলেন, দেশীয় ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোই আমদানিনির্ভরতা কমানোর মোক্ষম পথ। গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সকে আরও কাজে লাগানো দরকার।

জ্বালানিবিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদদের মতো আমরাও মনে করি, ভোলাসহ দেশের স্থল ও সমুদ্রে সম্ভাবনাময় অঞ্চলে গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান জোরালো করা প্রয়োজন। আড়াই দশকেও ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে না পারাটা চূড়ান্ত অবহেলা ও ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়। গ্যাস-সংকটের কারণে যখন শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তখন ভোলার গ্যাস অব্যবহৃত পড়ে থাকে কীভাবে?

দ্বীপজেলা ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার জন্য পাইপলাইন নির্মাণ করা প্রয়োজন। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে, ভোলার গ্যাস আপাতত সিএনজিতে রূপান্তর করে কনটেইনারে ভরে মূল ভূখণ্ডে এনে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হবে। আমরা মনে করি, সময়ক্ষেপণ না করে ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে হবে।