সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বিদায় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম

কর্ম ও সাধনার মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও দেশ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় যে কয়জন অর্থনীতিবিদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তাঁদের অন্যতম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পিআইডিইর প্রধান কিংবা পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর কর্ম ও সাধনার কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণমানুষের সমৃদ্ধি। এমনকি বিদেশে যখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চ পদে আসীন ছিলেন, তখনো তাঁর ভাবনায় ছিল দেশ।

অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের জন্ম ১৯২৯ সালে, চট্টগ্রামের পটিয়ায়। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন সহযোগী অধ্যাপক পদে। ১০ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসের (পিআইডিই) প্রধান হিসেবে করাচি চলে যান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি অর্থনীতির পাঠ্যক্রম উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। পিআইডিইর প্রধান হিসেবে নুরুল ইসলাম পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরেছেন।

সত্তরের নির্বাচনে জয়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফাভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরির জন্য অর্থনীতিবিদদের নিয়ে যে প্যানেল করেছিলেন, তার প্রধানও ছিলেন তিনি। এই পরিকল্পনা তৈরির সময় নিয়মিত বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত বৈঠক হতো। একপর্যায়ে নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ছয় দফার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করলে তো এক পাকিস্তান থাকে না। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছয় দফার ভিত্তিতেই পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।’

১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নুরুল ইসলাম ভারত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং সেখানে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতার পর নুরুল ইসলাম বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে তাঁর সহযাত্রী ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. আনিসুর রহমান ও ড. মুশাররফ হোসেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে নুরুল ইসলাম ছুটি নিয়ে বিদেশ যান।

১৫ আগস্ট ঘাতক চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিহত হলে তিনি বিদেশেই থেকে যান। এ সময় কাজ করেছেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ও খাদ্যনীতিবিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) মতো প্রতিষ্ঠানে।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ইফ্রির ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। যদিও সুহৃদ-স্বজনদের ডাকে মাঝেমধ্যে দেশে এসেছেন।

নুরুল ইসলাম পেশা ও গবেষণাকাজে দীর্ঘ সময় বিদেশে কাটালেও দেশ নিয়ে যে সারাক্ষণ চিন্তা করতেন, সেই সাক্ষ্য দেয় তাঁর গবেষণাকাজ, সভা-সেমিনারে দেওয়া বক্তৃতা-বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার। প্রথম আলোও তার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়নি। প্রথম আলোর একাধিক সেমিনারে যোগ দিয়ে নুরুল ইসলাম দেশ নিয়ে তঁার আশা ও শঙ্কার কথা বলেছেন।

দেশের সার্বিক অগ্রগতির জন্য অবকাঠামো, যোগাযোগ, পরিবহন ও জ্বালানির উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসনের ওপর জোর দিয়েছেন। তঁার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হচ্ছে মেকিং অব এ নেশন বাংলাদেশ, অ্যান অডেসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ: আ প্রাইমার অন পলিটিক্যাল হিস্ট্রি, ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানিং ইন বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ছিলেন পরিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ। দেশে-বিদেশে পুরো জীবনই তিনি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘কত কাজ নিয়ে সারা জীবন পাগল হয়ে থাকলাম। পরিবার, বন্ধুবান্ধবকে সময় দিইনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দুঃখ হয় যে এটা শুধু চলার পথ, ফেরার পথ নয়।’

অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম নিজের কাজ ও সাধনার মাঝে বেঁচে থাকবেন। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।