ক্ষমতা বদলায় কিন্তু সড়ক পরিবহন খাত বদলায় না। এ খাতের ব্যক্তিরা এতটাই ক্ষমতাবান যে তাঁরা সরকারের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সাহস পান, শ্রমিক সংগঠনের নামে তাঁরা প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদা তোলেন, অথচ এই খাতদের সাধারণ শ্রমিকেরা মানবেতর জীবন যাপন করেন। তাঁদের মজুরি ও চাকরির নিশ্চয়তা নেই।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবহন মালিক সমিতির প্রধান কার্যালয়টির নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন বিএনপিপন্থী পরিবহন নেতারা। এত দিন এটি আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে ছিল। কেবল কেন্দ্রীয় অফিস নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা মালিক সমিতির নেতৃত্বেও পরিবর্তন এসেছে।
বিএনপির নেতা সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিও করা হয়েছে। তাঁর দাবি, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে তাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের লোকজনও একই রকম দাবি করে নেতৃত্বে এসেছিলেন।
সারা দেশের পরিবহনশ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনে এত দিন একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের। পটপরিবর্তনের পর তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা সংগঠনের প্রধান কার্যালয়ে আসছেন না। এ সুযোগে তাঁদের অধীন থাকা টার্মিনাল, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক ইউনিয়ন কমিটির কার্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণও হাতবদল হওয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর সায়েদাবাদ, জয়কালী মন্দির ও গাবতলী বাস টার্মিনালে অবস্থিত শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় বিএনপিপন্থীরা দখলে নিয়েছেন। ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে বাস ও ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের দুটি কার্যালয়ই হাতবদল হয়েছে। রংপুর, নীলফামারীর সৈয়দপুর ও জামালপুরেও শাজাহান খানের লোকজন কর্তৃত্ব হারিয়েছেন।
শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন ফেডারেশনের কমিটিতে আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপি, বাসদ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের লোকজন আছেন। বর্তমান কমিটিতে কার্যকরী সভাপতি আবদুর রহিম বখশ ও সহসভাপতি শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান বিএনপির নেতা। ক্ষমতার পালাবদলের পর বিএনপির নেতারা সামনে এসেছেন।
বিএনপির নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বলেছেন, ‘নতুন সরকার এলে কিছু লোক ফেডারেশনে ঢোকে, আবার সরকার গেলে বেরিয়ে যায়। বিএনপির পক্ষ থেকে দখল–দলীয়করণ বন্ধে কঠোর নির্দেশনা আছে।’ কিন্তু সেই নির্দেশনা কি পালিত হচ্ছে?
গত ৫ মার্চ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদার ভাগ পান দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা।
এ কারণেই পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে যাঁরাই থাকুন, তাঁরা অন্যদের পুরোপুরি বঞ্চিত করতে চান না। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মিলেমিশে চাঁদা ভাগাভাগি করতেন। ক্ষমতার পালাবদলের পর সেটি বন্ধ হবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।
পরিবহন খাতের নেতৃত্বে কারা আছেন বা থাকেন, সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো পরিবহন খাতে বহু বছর ধরেই চাঁদাবাজি ও দখলবাজি বন্ধ হবে কি না। চাঁদাবাজি বন্ধ হলে ভাগাভাগির রাজনীতিও বন্ধ হবে। এই খাতের শ্রমিকেরা ন্যূনতম মজুরি পাবেন। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে। সাধারণ মানুষও ভাড়া–নৈরাজ্য থেকে রেহাই পাবে।
অন্তর্বর্তী সরকার যে রাষ্ট্র সংস্কার করতে চাইছে, পরিবহন খাত দিয়েই সেটা শুরু করা যেতে পারে।