বিধি মেনেই নিয়োগ ও পদায়ন হতে হবে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দুই সপ্তাহ পরও জনপ্রশাসনে একধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছে। সচিবালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও মাঠপর্যায়ের প্রশাসনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসায় জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলার প্রধান কারণ আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছর দেশ চালিয়েছে স্বেচ্ছাচারী কায়দায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা পছন্দসই ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে, যোগ্যতা থাকুক আর না-ই থাকুক। সরকার পরিবর্তনের পর এসব কর্মকর্তা হয় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন অথবা তাঁদের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে বিক্ষোভ করেছেন। কোনো কোনো দপ্তরে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা হেনস্তার শিকার হয়েছেন বলেও সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। এই ঘটনায় একজন সচিব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর ২৯ বছরের চাকরিজীবনে এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি।

অন্তর্বর্তী সরকার গত সরকারের আমলের নিয়োগ পাওয়া অনেকের চুক্তি বাতিল করেছে, এর মধ্যে ১১ জন সচিবও আছেন। প্রশাসন চালাতে হলে এসব শূন্য পদে নিয়োগ দিতে হবে এবং সরকার ইতিমধ্যে সেই কাজও শুরু করেছে। কিন্তু এক দল লোকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে আরেক দল লোককে একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে জনপ্রশাসনে ক্ষোভ-অসন্তোষ ছিল বহু বছর ধরেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, প্রশাসনে অনেক যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তা থাকতে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ মন্দ নজির হয়ে থাকবে। এ ধরনের নিয়োগে পদোন্নতিপ্রত্যাশীরা বঞ্চিত হন। আগের সরকারের আমলে তাদের আস্থাভাজন ব্যক্তিরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়ে থাকলে এবার তার ব্যতিক্রম হবে, তার নিশ্চয়তা কী। 

সরকার ১৭ আগস্ট যে পাঁচজনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেক বছর আগে অবসরে যাওয়া ব্যক্তিরাও আছেন। এ ক্ষেত্রে পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিগত সরকার যদি এসব কর্মকর্তার প্রতি অবিচার করে থাকে, আইনি প্রক্রিয়ায়ই তার প্রতিকার খুঁজতে হবে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে নয়। প্রথম কথা হলো, প্রশাসনে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা থাকতেও কেন নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হবে? আওয়ামী লীগ সরকারের বিরাগভাজন হিসেবে যাঁরা পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে নিয়োগ দিতে পারত। কিন্তু সেটা না করে আবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়াটা ভালো দৃষ্টান্ত হলো না। 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, যখন সরকার পরিবর্তন হয়, তখন আরেকটু জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন দরকার হয়। তাঁর ভাষায়, ‘বিশেষ বিবেচনায় অনেক জায়গায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন অনেকে।’ কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার কেন একই নীতি অনুসরণ করবে? 

এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যথার্থই বলেছেন, একটি দলীয়করণের পরিবর্তে আরেকটি দলীয়করণের সুযোগ সৃষ্টি করছে, সেটার প্রতি নজর রাখতে হবে। প্রশাসন সাজাতে এমনভাবে অগ্রসর হতে হবে, যাতে পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো ঝুঁকি না থাকে।

দলীয়করণে বিধ্বস্ত প্রশাসনকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হলে একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে পদায়ন ও পদোন্নতির কাজ করতে হবে। আগের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে নতুন করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ভালো সমাধান নয়। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে বিশেষায়িত শিক্ষায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া কোনো পদেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ কাম্য নয়। প্রতিটি নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি হতে হবে প্রশাসনিক বিধিমালা মেনে।