সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ক্ষতিকর প্লাস্টিক

কঠোর নীতিগত অবস্থানের বিকল্প নেই

৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে প্রথম আলোয় বুড়িগঙ্গাপাড়ের প্লাস্টিকের বর্জ্য নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে যেসব তথ্য এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণার বরাতে এই প্রতিবেদনে বলা হয়, বুড়িগঙ্গাপাড়ের মাটি খুঁড়লেই পাওয়া যাচ্ছে প্লাস্টিক। মাটির অন্তত ৭ ফুট নিচেও মিলছে প্লাস্টিক। পাড়ের এসব প্লাস্টিক পরে গিয়ে জমা হয় নদীর তলদেশে।

সে ক্ষেত্রে নদী ও নদীপাড়ের মাটি দুটিই প্লাস্টিকের আক্রমণে বিপন্ন। এই বিপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় কী। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে প্রতিবছর সারা বিশ্বে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘সলিউশনস টু প্লাস্টিক পলিউশন’।

এর অর্থ, দৈনন্দিন প্রয়োজনে মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহার করলেও এর পরিবেশগত ক্ষতি বা দূষণ কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, এ নিয়ে সারা বিশ্বেই কাজ হচ্ছে। পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করছেন। উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ রক্ষায় নানা পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশেও সভা-সেমিনারে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নানা আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছেন। কিন্তু দূষণ রোধে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।

দেশে প্লাস্টিক দূষণ ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে চলেছে। এতে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ক্যানসার, কিডনির জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের ব্যাধির অন্যতম কারণ প্লাস্টিক। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) তথ্যমতে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। প্লাস্টিক-জাতীয় পণ্য কখনো পচে না, যার কারণে এর বর্জ্য পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি করছে। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মাছ পশুপাখির মাধ্যমে খাদ্যচক্রে ঢুকে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। কমাচ্ছে জমির উর্বরতাও।

দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহারও বেড়ে চলেছে মাত্রাতিরিক্ত হারে। শহরাঞ্চলে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ২০০৫ সালে ছিল ৩ কেজি। ২০২০ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ৯ কেজি। ঢাকা শহরে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ এ সময়ে ৯ থেকে ২৪ কেজি হয়েছে। দেশে সারা বছর যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয়, তার ১০ শতাংশ প্লাস্টিক পণ্য থেকে আসে। এর ৪৮ শতাংশ মাটিতে পড়ে, আর ৩৭ শতাংশ পুনরায় ব্যবহৃত হয়। ১২ শতাংশ পড়ে খাল ও নদীতে। আর ৩ শতাংশ নালায় গিয়ে মেশে।

পলিথিন ও প্লাস্টিক দুটোই পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সরকার ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করেছিল। কিছুদিন এর ব্যবহার সীমিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে সরকার সেই অবস্থান থেকে সরে আসে। পলিথিনে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। সরকারি পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ চালুর যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা–ও ভেস্তে যায়। এ অবস্থায় প্লাস্টিকের ব্যবহারও পুরোপুরি বন্ধ করা কতটা সম্ভব, সেই প্রশ্ন উঠে এসেছে।

আমরা মনে করি, এর ব্যাপারে সরকারের কঠোর নীতিগত অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান বাস্তবতায় অন্তত সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পরিবেশ আইন কার্যকর করার মাধ্যমে পরিবেশগত ক্ষতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি জনসচেতনতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবহার করা প্লাস্টিক যে যত্রতত্র ফেলা যায় না, সেই সচেতনতাও তৈরি হতে হবে।