ঢাকা শহরের মশকনিধন তথা মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। এই দুই সিটি করপোরেশনের দুজন মেয়র ছাড়াও আছেন অনেক কর্মকর্তা, আছেন প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য একজন কাউন্সিলর। কিন্তু জাঁকজমকপূর্ণ অফিস ও বুলন্দ আওয়াজ ছাড়া তাঁদের কাজকর্ম খুব একটা মালুম করা যায় না।
দুই সিটি করপোরেশন এই শহরে ঢাকঢোল পিটিয়ে মশকনিধন অভিযান চালালেও মশার উপদ্রব কমেছে, এমন কথা কেউ বলবেন না। বরং মশার উপদ্রবে ঢাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, মে থেকে অক্টোবর মাসে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। কিন্তু এবার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের ঘটনা নগরবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। এডিস মশা ছাড়াও অন্য মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ নগরবাসী।
মশকনিধনে সকালে যে ওষুধ ছিটানো হয়, সেই প্রক্রিয়াকে লার্ভিসাইডিং বলে। বিকেলে মশা মারতে ফগিং (ওষুধ ছিটানো ধোঁয়া) করা হয়। কিন্তু ১৭ এপ্রিল প্রথম আলোয় ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মশকনিধন অভিযানের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা খুবই হতাশাজনক। নিয়ম অনুযায়ী দিনে আট ঘণ্টা অভিযান পরিচালনার কথা থাকলেও চলে তিন থেকে চার ঘণ্টা। মশকনিধনকর্মীরা কাজ শুরু করেন দেরিতে, আবার শেষ করেন নির্ধারিত সময়ের আগে। অন্যদিকে কী পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করা প্রয়োজন, সে বিষয়েও তাঁদের ধারণা নেই। সরেজমিনে দেখা যায়, অনেক কর্মীই ছুটিতে আছেন। যেখানে ১৭ জন কর্মীর কাজ করার কথা, সেখানে করছেন ৮ জন—অর্ধেকের কম। এর অর্থ, তাঁরা পুরো এলাকায় মশকবিরোধী অভিযান চালাতে পারেন না।
প্রতিবছর মৌসুমের শুরুতে সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা আওয়াজ তোলেন—এবার তাঁরা দেখিয়ে দেবেন। কিন্তু তাঁরা দেখিয়ে দেওয়ার আগেই মশককুল দেখিয়ে দেয় এবং ডেঙ্গুর প্রকোপে জনজীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৮৯৯ জন। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩৭৯। একই সময়ে ডেঙ্গুতে সারা দেশে মারা গেছেন ২৩ জন, যার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের আওতাধীন এলাকায় ১০ জন।
২০২৩ সালে দেশে মোট ১ হাজার ৭০৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশন যেভাবে কাজ করছে, তা অনেকটা রুটিনমাফিক। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এবারও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। সিটি করপোরেশনের মশকবিরোধী অভিযানের বড় সমস্যা হলো সর্বস্তরের জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারা। স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রতিরোধক্ষমতা বেড়েছে, ফলে আগের ওষুধে আর কাজ হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে যে ওষুধ অধিকতর কার্যকর, সেটাই প্রয়োগ করতে হবে।
একসময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায়ও মশার প্রচণ্ড উপদ্রব ছিল। কলকাতা সিটি করপোরেশন জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশকনিধনে সফল হয়েছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনও একই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে বাসিন্দাদেরও নিজ নিজ ভবন ও আঙিনা মশকমুক্ত রাখতে হবে। ঢাকার মশক নিয়ন্ত্রণে এসেছে—এই আত্মতুষ্টিতে না ভুগে দুই মেয়রেরই উচিত এ ব্যাপারে সমন্বিত ও সর্বাত্মক কর্মসূচি নেওয়া।