কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে যেমন তার অবকাঠামো ও লোকবলের কথা ভাবতে হয়, তেমনি মাথায় রাখতে হয় এই প্রকল্প দ্বারা কত বেশিসংখ্যক মানুষ উপকৃত হবেন। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাণ্ড দেখে মনে হয়, প্রকল্প নেওয়াই তাঁদের একমাত্র কাজ, এ থেকে মানুষ আদৌ উপকৃত হলো কি না, সেসব নিয়ে তাঁরা খুব একটা চিন্তা করেন না।
পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে, এটা নিশ্চয়ই আনন্দের কথা। এর মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। আগামী জুলাইয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ চালুর প্রস্তুতি আছে। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেললাইন যুক্ত করা হয় সেতু চালুর অনেক পরে। কিন্তু পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় শুরুতেই। বলা হয়েছিল, এটি হবে বহুমুখী। সড়ক ও রেল যোগাযোগের কাজে লাগবে।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হয়। রেলপথে পদ্মার দুই পারে যোগাযোগ স্থাপন করতে নেওয়া হয় আলাদা প্রকল্প, যা ‘পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প’ নামে পরিচিত। গত বছরের ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু হয়ে রেলপথের উদ্বোধন হওয়ার পর ১ নভেম্বর শুরু হয় যাত্রী নিয়ে ট্রেন চলাচল।
কিন্তু লোকবলের অভাবে পদ্মা সেতু দিয়ে চলমান ট্রেনের সংখ্যা যদি বাড়ানো না যায়, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। বর্তমানে মাত্র চার জোড়া ট্রেন চলাচল করছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চীন থেকে ১০০ নতুন কোচ আনা হয়েছে। এসব কোচ দিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে নতুন রেলপথে সাত-আটটি আন্তনগর ট্রেন চালানো সম্ভব। পর্যাপ্ত ট্রেন চালানো যাচ্ছে না বলে উল্লিখিত কোচের একটি অংশ দেশের অন্যান্য রেলপথে যুক্ত করা হয়েছে।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, পদ্মা সেতুর দুই পারে রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের ঋণের পরিমাণ ২৬৭ কোটি ডলার। ট্রেন পুরোপুরি চালু না হলেও ঋণের সুদ দিতে হচ্ছে সরকারকে। যাত্রীবাহী ট্রেনের সঙ্গে পণ্যবাহী ট্রেন না চলাচল করলে এত বিপুল অঙ্কের ঋণের সুদ পরিশোধ করা বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
প্রকল্পের সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, নতুন এই রেলপথ চালু হলে প্রতিদিন ২৪ জোড়া বা ৪৮টি যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করতে পারবে। তবে লোকবলের অভাব, ইঞ্জিনের সংকটসহ নানা কারণে এই লাইনের পুরো সক্ষমতা কাজে লাগাতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। ঢাকা থেকে ফরিদপুর, রাজবাড়ীসহ আশপাশের এলাকায় কমিউটার ট্রেন (কম দূরত্বে যাতায়াতের জন্য) চালুর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ কমানোর কথাও বলা হয়েছিল সমীক্ষায়।
প্রকল্প প্রস্তাবে নতুন এই রেলপথে ট্রেন চালানো, যাত্রীসেবা দেওয়া এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন শ্রেণির ১ হাজার ৬৮০ জন নতুন লোক নিয়োগের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছিল। এ নিয়ে এক বছর ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চিঠি-চালাচালি করেও অনুমোদন করাতে পারেনি রেলওয়ে মন্ত্রণালয়। রেলের কর্মীদের নিয়োগের পর সংশ্লিষ্ট কাজের যোগ্য করতে কমপক্ষে দেড় বছর সময় দরকার।
যেখানে নতুন লোকবল ট্রেন চালানোর মতো সক্ষমতা তৈরি হতে দেড় বছরের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, সেখানে এই গাফিলতির দায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এড়াতে পারেন না।
‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া’ বলে একটি প্রবাদ আছে। গাড়ি চালানোর লোকই যদি নিয়োগ না করা হয়, তাহলে বিদেশি ঋণসহ কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ কি নিছক আধুনিক রেললাইন ও স্টেশনগুলো দেখানোর জন্য? এই প্রশ্নের উত্তর রেলওয়ের কর্তাব্যক্তিদেরই দিতে হবে।