সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো স্থাপনা নয়

সুন্দরবন কেবল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ নয়, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এই বন যে আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে, অতি সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় রিমাল আরও একবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। মা যেমন সন্তানকে বুকে নিয়ে বাইরের বিপদ থেকে রক্ষা করেন, তেমনি সুন্দরবনও প্রতিবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে আমাদের সুরক্ষা দেয়।

কিন্তু নির্বিচার গাছ কাটার পাশাপাশি একশ্রেণির রিসোর্ট ব্যবসায়ী পর্যটকসেবার নামে সুন্দরবন ধ্বংসের কাজে নেমে পড়েছেন। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় একের পর এক রিসোর্ট গড়ে উঠছে। বনের গাছ কেটে, খাল ভরাট করে খুলনা ও সাতক্ষীরায় ১৪টি রিসোর্ট (অবকাশকেন্দ্র) গড়ে তোলা হয়েছে। আরও ৮টির নির্মাণকাজ চলছে। রিসোর্টগুলো চালানোর জন্য বিকট শব্দে চলছে জেনারেটর। বাজছে সাউন্ড সিস্টেম বা শব্দযন্ত্র। বেশির ভাগ রিসোর্টে স্থাপন করা হয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকায় সেখানকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষতি করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ কিংবা কোনো কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু রিসোর্টের মালিকেরা এসব নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে একের পর এক স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছেন। রিসোর্টগুলোর আশপাশে পানি, শব্দ ও মাটিদূষণ বাড়ছে। বনের প্রাণীরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

 সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক সুন্দরবন ঘিরে কমিউনিটি-বেজড ইকো–ট্যুরিজম নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন, ২০১৮ সালে খুলনার দাকোপ ও বাগেরহাটের মোংলা এলাকায় সুন্দরবন ঘিরে ইকো কটেজের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩। ২০২৩ সালে রিসোর্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২। ২০২৩ সালে ১২টি রিসোর্টের ৭৪টি কক্ষে পর্যটক থাকতে পারতেন ২৬০ জন। চলতি বছর আরও ৫৮ কক্ষবিশিষ্ট ৮টি কটেজ তৈরি হচ্ছে। ৭টি পুরোনো কটেজে নতুন ৪২টি কক্ষ তৈরির কাজ চলছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ২০টি কটেজে পর্যটক ধারণক্ষমতা দাঁড়াবে ৫৬০ জনে।

আরও কৌতূহলের বিষয় হলো, সাতক্ষীরায় দুটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) রিসোর্ট নির্মাণে যুক্ত হয়েছে। এনজিওগুলোর কাজ দরিদ্র মানুষের সেবা ও পরিবেশের সুরক্ষা দেওয়া। সেখানে তারা পরিবেশ নষ্ট করে কেন রিসোর্ট ব্যবসা করবে?

সাবেক প্রধান বনরক্ষক ও আইইউসিএর এদেশীয় সাবেক পরিচালক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের চারপাশে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠাসহ নানা ধরনের বিপদ বাড়ছে। এভাবে যদি অবৈধভাবে রিসোর্ট তৈরি চলতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে সুন্দরবনের অবস্থা আমাদের গাজীপুরের ভাওয়াল বনের মতো হবে।’ খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ইকবাল হোসেনও স্বীকার করেছেন, একের পর রিসোর্ট হওয়ায় পরিবেশ ও সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, সেই ক্ষতি প্রশমনে কি তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে, না নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে? সরকার যদি সুন্দরবনের অবস্থা ভাওয়াল বনের মতো হোক সেটা না চায়, তাহলে সংশ্লিষ্টদের এখনই কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কোনো স্থাপনা নির্মাণ হয়ে যাওয়ার পর ভাঙা কঠিন; বরং সরকারের উচিত হবে আইনকে ফাঁকি দিয়ে কেউ যাতে স্থাপনা নির্মাণ করতে না পারে।

এ বিষয়ে আমরা বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রিসোর্ট করলে সেখানে বর্জ্য তৈরি হবে, সেই বর্জ্য ফেলা হবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত নদীতেই। সুন্দরবন দেখতে প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক যান। তাঁদের থাকার জন্য রিসোর্টেরও প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা হতে হবে প্রতিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত এলাকার বাইরে।