কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সশস্ত্র সংঘর্ষ চলে আসছে, তাতে মনে হবে এটা কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপের লড়াই-সংঘাতের উন্মুক্ত ক্ষেত্র।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার বিকেলে দুই দফায় সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের দুই উপপক্ষ সিক্সটি নাইন ও সিএফসি। এতে পুলিশের ৩ সদস্যসহ আহত হন ২৯ জন। গত শুক্রবার বিকেলে সংঘর্ষ চলাকালে তোলা বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ, ছবি ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বিবদমান সিএফটি ও সিক্সটি নাইন উপগ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে ৬০টি রামদা ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া হকিস্টিক, লাঠিসোঁটা তো ছিলই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে এত দেশীয় অস্ত্র আসে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্ত্রমুক্ত রাখতে কি প্রশাসনের কোনো কর্তব্য নেই?
ছাত্রলীগ নামধারী এই নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনের পর দিন অস্ত্রের মহড়া দেবে আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে, এটা হতে পারে না। কখনো কখনো তারা এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় যে ছাত্রলীগের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ফারাক করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অনুশীলনের স্থান, অস্ত্রবাজির নয়।
বৃহস্পতিবার সংঘর্ষে লিপ্ত রামদাধারীদের ছবি প্রথম আলোসহ সব সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরও প্রশাসন দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল। তাদের তখনই ঘুম ভাঙল, যখন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংঘর্ষে লিপ্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানালেন। রোববার প্রশাসন লম্বা বৈঠক করে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা মাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে ঘটনা লোকচক্ষুর সামনে ঘটল, রামদা হাতে এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, সেখানে শিক্ষামন্ত্রীর অনুরোধের আগে কেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিল না। দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে তাদের এত অনীহা কেন? অতীতে সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের লঘু শাস্তি দিয়েও পরে ‘মানবিক’ কারণ দেখিয়ে তা মওকুফ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ১১টি পক্ষে বিভক্ত। এর মধ্যে আ জ ম নাছিরের ৯টি আর বাকি ২টি মহিবুল হাসানের পক্ষ বলে পরিচয় দেয়। দুই পক্ষ-উপপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ চলে আসছে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে। সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি ও সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর কমিটি বাতিল করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
কিন্তু এই বাতিল কমিটির নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কাণ্ড ঘটানোর সাহস কোথা থেকে পায়। বিবদমান উপপক্ষগুলো আওয়ামী লীগের যেই দুই নেতার অনুসারী বলে নিজেদের দাবি করছে, এ বিষয়ে তাদেরও অবস্থানও পরিষ্কার করা উচিত। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের বিরোধের জের ধরে বছরের পর বছর ক্যাম্পাসে অসহনীয় অবস্থা চলতে পারে না। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। কোনো অপরাধী শাস্তি পায়নি।
প্রশ্ন হলো, ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করতে হবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া কি প্রশাসনের দায়িত্ব নয়? ২০০৯ সাল থেকে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলে এলেও বর্তমান প্রশাসনের আমলে সেটি অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
ছাত্রলীগের এই অব্যাহত মাস্তানি-সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়ার পর উপাচার্যসহ প্রশাসনের পদাধিকারীদের পদে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার থাকার কথা নয়।