সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

খণ্ডকালীন প্রশাসক নিয়োগ সমাধান নয়

স্থানীয় সরকার সংস্থা কীভাবে পরিচালিত হবে, তা সংবিধানেই লেখা আছে। কিন্তু সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর স্বকীয় অবস্থানকে স্বীকার করেনি। যখন যেই দল ক্ষমতায় এসেছে, স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার সহজ সমাধান হিসেবে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দিয়েছে এবং সিটি করপোরেশনগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ৩২৩ জন পৌর মেয়র, ৬০ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ৪৯৩ উপজেলা চেয়ারম্যান, সঙ্গে ৯৮৮ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানকেও অপসারণ করা হয়েছে। এরপর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদেরও অপসারণ করা হয়।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, আওয়ামী লীগ আমলে গঠিত স্থানীয় সরকার সংস্থা তথা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে? কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এভাবে ঢালাও জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করা ঠিক হয়নি। যেসব জনপ্রতিনিধি লভ্য ছিলেন, তাঁদের নিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো চালানো যেত। আর যেসব সংস্থার পদাধিকারীরা পলাতক আছেন, তাঁদের স্থলে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারত সরকার।

দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচন হয়ে আসছিল নির্দলীয় ভিত্তিতে, যদিও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করে। ফলে আগে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর যতটুকু বহুদলীয় চরিত্র ছিল, সেটাও মুছে যায়। ফলে স্থানীয় সরকার সংস্থার জনপ্রতিনিধি ও ক্ষমতাসীন দলের কমিটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আর কোনো ফারাকই থাকল না।

অন্যদিকে এই প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যে নীতি নিয়েছে, সেটা যথাযথ নয়। বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনগুলোতে। ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের পরিষেবার জন্য দুজন খণ্ডকালীন প্রশাসক নিয়োগ কোনোভাবেই সমীচীন নয়। এসব প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই সার্বক্ষণিক প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও পৌরসভাগুলোকে যেভাবে আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এগুলো আর জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠান থাকল না।

অন্তর্বর্তী সরকার যে নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে চায়, তাতে স্থানীয় সরকারের কী ভূমিকা থাকবে, তা–ও স্পষ্ট নয়। সরকার নির্বাচন, প্রশাসনসহ অনেক বিষয়ের সংস্কারে কমিশন গঠন করলেও স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো অনির্দিষ্টকাল প্রশাসক দিয়ে চলতে পারে না।

আওয়ামী লীগ সরকার কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো গঠন করেছে, এটা অসত্য নয়। ঢালাওভাবে প্রশাসক নিয়োগ এর প্রতিকার নয়। প্রশাসক নিয়োগ স্বল্পকালীন সমাধান হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পূর্ণকালীন প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে।

স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বশীল করতে হলে এর নির্দলীয় চরিত্র ফিরিয়ে আনারও বিকল্প নেই।