সংখ্যালঘুদের ভূমি দখল

দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হোক

এ দেশে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা বিরল নয়। এসব ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে থাকে, আবার কখনো অন্য কৌশলের আশ্রয় নেয়। উদ্দেশ্য মূলত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি ও ঘরবাড়ি দখল করা।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের (সিএ) বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও) গত বুধবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ৭০ ভাগই ভূমিকেন্দ্রিক। আর এ সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সংখ্যালঘুদের বিষয়সম্পদ বা ধর্মীয় উপাসনালয়ে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন সহিংসতার ধরন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য দিয়েছে সংস্থা দুটি।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লিখিত সহিংসতার ৫৯ ভাগই ঘটে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংসের মাধ্যমে। আর ১১ শতাংশ সরাসরি ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধকে ঘিরে। সহিংসতার মাধ্যমে ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহ বা হত্যার ঘটনা ঘটে। মোট ২ শতাংশ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, আর ১ শতাংশ নির্বাচনকেন্দ্রিক। প্রতিবেদনটি বলছে, এই সহিংসতা ঘটানোর ক্ষেত্রে এখন বড় ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে (মূলত ফেসবুক) ছড়ানো অপতথ্য। নারীরা এর ভুক্তভোগী হচ্ছেন বেশি মাত্রায়।

বিএনপি আমলে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতাই প্রধান হয়ে উঠেছিল সংখ্যালঘুদের ওপরে। আওয়ামী লীগ আমলে সেটি কমলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অন্যান্য সহিংসতা বাড়ছে। ২০১৬ সালে রসরাজ দাস নামের এক যুবকের ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা হয়। কিন্তু পিবিআই ও সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ পরীক্ষা করে মুঠোফোন ও মেমোরি কার্ডে এ ধরনের ছবির অস্তিত্বই পায়নি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছে। রামুতে বৌদ্ধদের মন্দির পোড়ানোর আগেও একই অপতথ্য ছড়ানো হয়েছিল। ২০২২ সালে কুমিল্লায় দুর্গোৎসবের সময় দেশের বেশ কয়েকটি জেলায়ও অপতথ্য ছড়িয়ে হামলা চালানো হয়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব সহিংসতার বিচার হয় না। সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। বছরের পর বছর চলে যায়, তদন্তকাজ শেষ হয় না। ফলে সার্বিকভাবে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয়। সম্প্রতি সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের যে অবৈধ সম্পদের হিসাব পাওয়া গেছে, তার মধ্যে বড় একটি অংশ গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের সংখ্যালঘুদের পৈতৃক জমি, তিনি ভয়ভীতি দেখিয়ে কিনেছেন। নারায়ণগঞ্জে তাঁর যে ডুপ্লেক্স বাড়ি, সেটাও সংখ্যালঘুদের জমিতে। 

সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন সহিংসতার উৎস হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্য। একে পুঁজি করছে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত মনে করেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রের ইন্ধন থাকে।

অতীতে এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও এগিয়ে আসতে দেখা যেত। কিন্তু এখন তাদের মধ্যেও একধরনের নিষ্ক্রিয়তা কাজ করছে। বিএনপির আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার জন্য তাদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করা হতো। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক দাবিদার আওয়ামী লীগ আমলে যখন সংখ্যালঘুদের জমি ও সম্পদ দখল হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা কাকে দায়ী করবে? সরকারের কাছেই–বা এই প্রশ্নের কী উত্তর আছে? আমরা সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করছি। সংখ্যালঘুদের দখল হওয়া জমি উদ্ধারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।