সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

সীমান্তেই রুখতে হবে ভয়ংকর মাদক

বাংলাদেশে যখন ফেনসিডিলের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল, সীমান্তসংলগ্ন ভারতীয় এলাকায় তখন নতুন নতুন ফেনসিডিল কারখানা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরে ফেনসিডিল ব্যবহার কমে গেলে সেসব কারখানাও বন্ধ হয়ে যায়। 

ফেনসিডিল আসত ভারত থেকে, এখন ফেনসিডিলের চেয়েও কয়েক গুণ বেশি ক্ষতিকর মাদক আসছে মিয়ানমার থেকে। যাঁরা মাদকের ব্যবসা করেন, তাঁরা নতুন নতুন মাদকের চালান দেশে নিয়ে আসেন। ২০১৭ সালে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আসার পর মাদকের চোরাচালানও বেড়েছে। এর বিরুদ্ধে সরকারের কথিত বন্দুকযুদ্ধ ও সর্বাত্মক অভিযানও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারেনি। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত (সেটি হোক কোস্টগার্ড কিংবা বিজিবি), দায়িত্ব পালনে তাদের কোথাও ঘাটতি বা অবহেলা আছে, নয়তো কোটি কোটি টাকার মাদক দেশের ভেতরে ঢুকতে পারত না। আর মাদক একবার দেশের ভেতরে ঢুকলে সেটি কোনো না কোনোভাবে ক্রেতা বা ভোক্তার কাছে যাবেই। 

ফেনসিডিলের পর বেশি আসত ইয়াবা। এখন আইস ইয়াবার স্থান দখল করে নিচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ফরেনসিক ল্যাবের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে আইসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে ইয়াবায় ম্যাথঅ্যামফিটামিন (একধরনের রাসায়নিক উপাদান) থাকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আর আইসে ম্যাথঅ্যামফিটামিন থাকে ৯৬ শতাংশ। এটি অল্প পরিমাণে সেবনে সাময়িকভাবে শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এ কারণে আগের ইয়াবাসেবীরা আইস সেবনে আগ্রহী হচ্ছে।

ইয়াবা কিংবা আইস দুটোই মারাত্মক ক্ষতিকর মাদক। এসব মাদকে যেসব তরুণ আসক্ত হয়ে পড়েন, তাঁদের জীবনই শুধু নষ্ট হয় না, পুরো পরিবার ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। সমাজেও এর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। কিশোর ও তরুণদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি করে। ফলে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে দেশে ৬৬ কেজি আইস বা ক্রিস্টাল ম্যাথ উদ্ধার হওয়ার ঘটনা দুশ্চিন্তাই তৈরি করে। জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধবিষয়ক সংস্থা (ইউএনওডিসি) বলেছে, বাজারে যত মাদক ঢোকে, তার মাত্র ১০ শতাংশ উদ্ধার করা হয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের ধরে নিতে হবে, উদ্ধার হওয়া মাদকের চেয়ে সেবন করা মাদকের পরিমাণ ৯ গুণ বেশি। 

যেখানে জল ও স্থলসীমান্তে সার্বক্ষণিক পাহারা দিয়ে থাকেন আমাদের সীমান্তরক্ষীরা, সেখানে এসব মাদক কীভাবে দেশের ভেতরে ঢোকে? সে ক্ষেত্রে সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো সীমান্ত পথে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন অভিযানে কাজ হবে না। সার্বক্ষণিক নজরদারি থাকতে হবে। 

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে যতটা বিপদ তৈরি করেছে, তার চেয়ে কম করছে না এই মাদক। দেশকে মাদকের থাবা থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশের ভেতরে মাদক আসা বন্ধ করতেই হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে যে আমাদের স্থলসীমান্ত আছে, সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। সীমান্তে কাঁটাতার কিংবা কংক্রিটের দেয়াল নির্মাণ করলেও কাজ হবে না, যদি সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনে কোনো ঘাটতি বা অবহেলা থেকে যায়। মাদক বন্ধে ‘লোকদেখানো’ অনেক অভিযান আমরা দেখেছি, এবার টেকসই ও সার্বক্ষণিক অভিযান জারি রাখা হোক। মাদকের ভয়াবহ থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে এর বিকল্প নেই।