সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

আবার গায়েবি মামলা

মৃত ব্যক্তি কীভাবে ‘সন্ত্রাসী কাজে’ যুক্ত হলেন?

কোনো ব্যক্তি আইন অমান্য করলে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এটাই আইনের শাসনের মূল কথা। কিন্তু যাদের এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক নেই, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের উদ্দেশ্য হয়রানি কিংবা রাজনৈতিকভাবে নাজেহাল করা ছাড়া কিছু নয়।

বাংলাদেশে যখন যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হাত করে কাজটি করে থাকেন। আবার তাঁরাই যখন বিরোধী দলে যান, একই রকম আচরণ পেয়ে থাকেন। দুর্ভাগ্য, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই ধারাই চলে আসছে বহু বছর ধরে।

মামলার বাদী গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা শাহ আলমের দায়ের করা মামলায় বলা হয়, গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গেন্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের মুরগিটোলা মোড়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর দা, লাঠিসোঁটা ও রড দিয়ে অতর্কিত হামলা করেন শওকতসহ বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

এ সময় তাঁরা ককটেলের বিস্ফোরণও ঘটান। এতে আওয়ামী লীগের সাতজন নেতা আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ গেলে ইট ছুড়ে পুলিশকেও আহত করা হয় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

অথচ প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মামলায় উল্লিখিত শওকত গত বছর ডিসেম্বরে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এখানে মৃত ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী মামলার আসামি করার কৃতিত্ব যিনি দেখিয়েছেন, তিনি পুলিশের সোর্স হিসেবেই পরিচিত। তিনি কেবল মৃত ব্যক্তিকে দিয়ে দা, লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর হামলার কাল্পনিক কাহিনি ফাঁদেননি, কারাগারে আটক, যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত ব্যক্তিদেরও এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন।

প্রথমেই ঘটনার স্থান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বাদীর মামলায় গেন্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের মুরগিটোলা মোড় পাকা রাস্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সেখানে কোনো অঘটন ঘটেনি। সংঘর্ষ হয়েছে ধোলাইখালে। প্রকৃতপক্ষে গেন্ডারিয়ার বিএনপি নেতা-কর্মীদের ফাঁসানোর জন্যই এই মামলা করা হয়েছে। মামলায় আসামিদের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের নাম রয়েছে। তাঁর স্ত্রী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত মাসের ২৬ তারিখ আমার স্বামীকে বাসা থেকে পুলিশ আটক করেছে। তিনি এখন কেরানীগঞ্জ কারাগারে।’

মহানগরীর ৭ থানায় পুলিশের করা ১১ মামলায় ৫৪৭ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৪৬৭ জনের নাম উল্লেখ আছে। বাকিরা অজ্ঞাতনামা। অজ্ঞাতনামা আসামি দেওয়ার সুবিধা হলো পরবর্তীকালে পুলিশ ইচ্ছেমতো সেখানে নাম ঢুকিয়ে দিতে পারে। এ তথ্য কেবল ঢাকা মহানগরীর।

ঢাকার বাইরে ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। ঢাকার ঘটনায় ৭০০ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। অথচ সেদিন বিএনপির নেতা-কর্মীরা যে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে মার খেলেন, সে জন্য কোনো মামলা হয়নি। বিরোধী দলের মামলা নেওয়ার নজিরও নেই।

এভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাইকারি মামলা করে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করলে কিংবা গায়েবি মামলাকে উৎসাহিত করলে আর যা-ই হোক, ন্যায়বিচার আশা করা যায় না। যদি সত্যিই কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে থাকেন, সরকার তঁার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে কারও আপত্তির কিছু থাকবে না।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কে কোন দল করে, সেটি দেখার সুযোগ নেই। যেই ব্যক্তি মৃত, কারাবন্দী ও প্রবাসীদের নামে ভুয়া মামলা করেছেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনা হোক।