জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার পাটহাটি মোড়ে একদল সন্ত্রাসীর হাতে সাংবাদিক গোলাম রব্বানির খুন হওয়ার ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। তিনি ছিলেন বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর জেলা প্রতিনিধি ও একাত্তর টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা সংবাদ সংগ্রাহক।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বুধবার রাত ১০টা ১৭ মিনিটের সময় গোলাম রব্বানি মোটরসাইকেল চালিয়ে পাটহাটি মোড় পার হয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একজন দৌড়ে গিয়ে চলন্ত মোটরসাইকেলটি পেছন দিক থেকে টেনে ধরে ও ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ফেলে দেয়।
এরপর সন্ত্রাসীরা গোলাম রব্বানিকে টেনেহিঁচড়ে কিল-ঘুষি ও বেদম মারধর করতে থাকে। মারধরে অংশগ্রহণকারী একজন সহযোগীদের উদ্দেশে বলতে থাকে, ‘ওই, তরা অন্ধকারে নিয়ে মার।’ এরপর তাঁকে সিসিটিভির আওতার বাইরে নিয়ে উপর্যুপরি মারধর করে সন্ত্রাসীরা। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তাঁকে ফেলে পালিয়ে যায়।
অভিযোগ উঠেছে, বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম লোকজন দিয়ে গোলাম রব্বানিকে হত্যা করিয়েছেন। মাহমুদুল আলম সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। নিহত গোলাম রব্বানির স্ত্রী মনিরা বেগমের অভিযোগ, ‘সংবাদ প্রকাশের জের ধরে সাধুরপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম তাঁর (গোলাম রব্বানি) ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং আগেও নানাভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছেন। ওই ইউপি চেয়ারম্যানের লোকজনই তাঁকে হত্যা করেছে।’
ইউপি চেয়ারম্যানের দ্বিতীয় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় তিনি সাংবাদিক গোলাম রব্বানির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁর (গোলাম রব্বানি) বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করলেও সেটি বাতিল হয়ে যায় বলে জানা গেছে। ধারণা করি, আইনি লড়াইয়ে ব্যর্থ হয়েই ওই চক্রটি সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও তাঁর সহযোগীরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী। এর আগে ১১ এপ্রিল এক যুবলীগ নেতাও গোলাম রব্বানিকে মারধর করেছিলেন। সে যাত্রায় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও এবার ঘাতকদের হাতে জীবন দিতে হলো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, গোলাম রব্বানি তাঁর প্রাণের নিরাপত্তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। সেই আকুতিও ব্যর্থ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসেছে। দেশে আইনের শাসন থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়।
গোলাম রব্বানির হত্যার পর জামালপুরের পুলিশ সুপার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা ঘাতকদের রক্ষার কৌশল বলে মনে করি। এক টিভি চ্যানেলে তাঁর বক্তব্যে প্রকাশ পায়, গোলাম রব্বানিকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করার জন্য আঘাত করেনি। তারা তাঁকে সতর্ক করতে চেয়েছিল। একজন আইনের রক্ষক হয়ে হত্যাকারীদের পক্ষে এভাবে সাফাই গাইবেন, তা ভাবা যায় না।
গোলাম রব্বানি হত্যার ঘটনায় যাকে মূল হোতা বলা হচ্ছে, সেই মাহমুদুল আলম ধরা না পড়াও রহস্যজনক। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একের পর এক সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হবেন, এটিই কি দেখে যেতে হবে আমাদের? একজন সাংবাদিক প্রাণের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেও বাঁচতে পারেননি।
এটি পুলিশ প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা, সেটি তাদের স্বীকার করে নিতে হবে। একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হবে, তারা সাংবাদিকদের সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর, অন্যদিকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে একজন সাংবাদিক হত্যার শিকার হবেন—এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিক সমাজ গোলাম রব্বানি হত্যার প্রতিবাদ করেছে। কর্মসূচি নিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বলতে চাই, গোলাম রব্বানি হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হোক। বিচারের বাণী যেন নিভৃতে না কাঁদে।