সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ফারদিন মৃত্যুরহস্য

তদন্ত সংস্থার উদ্‌ঘাটন কতটা বিশ্বাসযোগ্য

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর হত্যা মামলার তদন্তে নেমেছিল পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও এলিট ফোর্স র‍্যাব। প্রথম দিকে এই দুই সংস্থার তদন্তে ভিন্ন ভিন্ন ফল বেরিয়ে এলেও এখন তারা অভিন্ন সুরে বলছে, হত্যা নয়, ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন। এর কারণ হিসেবে আর্থিক অনটন ও হতাশার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

যেকোনো মানুষের মধ্যে হতাশা ও আর্থিক অনটন থাকতে পারে। তাই বলে সে কারণে আত্মহত্যা করার ঘটনা সাধারণ প্রবণতা নয়। ফারদিনের সহপাঠীদের কর্মসূচি থেকে ডেকে এনে ডিবির আত্মহত্যার বয়ান দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সুলতানা কামাল সেতু থেকে যিনি ঝাঁপ দিয়েছেন, সেই ব্যক্তিই যে ফারদিন, তার প্রমাণ কী? ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন তদন্ত সংস্থার উদ্‌ঘাটন প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’

কোনটি সত্য—র‍্যাব-ডিবির সর্বশেষ দাবি, না ফারদিনের বাবার বক্তব্য? প্রাথমিক তদন্তে র‍্যাব বলেছিল, ফারদিন হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ‘রায়হান গ্যাং’ সম্পৃক্ত। এই গ্যাংয়ের প্রধান রায়হান নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া বস্তির একাংশের নিয়ন্ত্রক। হত্যাকাণ্ডের রাতে ফারদিনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স সন্দেহে রায়হান ও তাঁর সহযোগীরা পিটিয়ে হত্যা করেছেন বলেও তারা ধারণা করেছিল।

সে সময় ডিবির ভাষ্য ছিল, মাদকসংশ্লিষ্টতায় খুন হতে পারেন তিনি। তবে চনপাড়া বস্তিতে নয়, এই তরুণকে ঢাকার অন্য কোথাও খুন করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেওয়া হয়। ডিবির প্রধান বলেছিলেন, ‘ফারদিনের মুঠোফোনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন জায়গায় তিনি যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের কোনো এক জায়গায় খুন হতে পারেন তিনি।’

র‍্যাব ও ডিবির এখনকার ভাষ্যের সঙ্গে আগের বক্তব্য একেবারেই মেলে না। দুই সংস্থার সর্বশেষ উদ্‌ঘাটন হলো, সুলতানা কামাল সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়ে ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন। তাহলে কিসের ভিত্তিতে তারা মাদক–সংশ্লিষ্টতার তথ্য দিয়েছিল? তরুণ বয়সী কেউ মারা গেলে বা আত্মহত্যা করলে সেই ঘটনার সঙ্গে মাদক–সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কারও সুস্থতার লক্ষণ নয়।

গত ৪ নভেম্বর বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন ফারদিন নূর পরশ। তার পর থেকেই নিখোঁজ তিনি। পরে ৫ নভেম্বর তাঁর বাবা রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে নৌপুলিশ। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ফারদিনের দেহে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে এটি হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করা হচ্ছে।

৯ নভেম্বর ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন বাদী হয়ে রামপুরা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। পরদিন মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় গোয়েন্দা পুলিশ। ছায়াতদন্তের দায়িত্ব পায় র‍্যাব।

যেকোনো ঘটনার তদন্তে সরকার একাধিক সংস্থাকে নিয়োগ দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যে সমন্বয় ও সহযোগিতা থাকা দরকার, ফারদিন হত্যা মামলার তদন্তে তার প্রচণ্ড ঘাটতি ছিল।

দুই সংস্থার মধ্যে কৃতিত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতায় অনেক সময় সত্য হারিয়ে যায়। ফারদিনের ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনে রাখা প্রয়োজন, তদন্ত একই সঙ্গে তথ্যনির্ভর ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।