ঢাকায় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতারা যখন একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগের তূণ ছুড়ছেন, তখন দেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত মানুষগুলো কী অবস্থায় আছে, সে বিষয়ে কারও নজর নেই। সিলেট অঞ্চলে বন্যার পানি কমে গেলেও এখনো লাখ লাখ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারেনি। বিশেষ করে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার প্রতিটি উপজেলার মানুষই বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
রংপুর-কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। অনেকের ঘরবাড়ি বন্যায় ভেসে গেছে অথবা এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে বসবাস করা সম্ভব নয়। কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন, কারও ঠাঁই হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উঁচু বাঁধে।
কিন্তু এই বিপুল দরিদ্র ও দুর্গত মানুষের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির সংস্থান নেই। বন্যার কারণে তঁাদের জীবিকাও বন্ধ। স্থানীয় প্রশাসন থেকে যে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বন্যাদুর্গত মানুষের বেশির ভাগই মৎস্যজীবী ও কৃষিজীবী।
অন্যদিকে যেসব অঞ্চলে পানি কমে গেছে, সেখানকার মানুষ নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেলেও অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন। তঁাদের অনেকের ঘর মেরামত করার সামর্থ্য নেই। পানি সরে গেলেও অনেক এলাকার বিদ্যালয় এখনো খোলার মতো অবস্থা হয়নি। এর ফলে শিশুদের পড়াশোনা প্রায় বন্ধ। তবে বন্যাদুর্গত এলাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পানিবাহিত রোগ। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় হাসপাতালে সীমিত চিকিৎসা দেওয়া হলেও ঘরে ঘরে ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। জরুরি ভিত্তিতে মেডিকেল টিম পাঠানো প্রয়োজন। যেসব স্থানে সেতু ও সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো দ্রুত মেরামত করা প্রয়োজন।
অতীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা বিপন্ন মানুষের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন, স্থানীয় পর্যায়েও বিত্তবানেরা দরিদ্র প্রতিবেশীদের সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। কিন্তু এবারের বন্যায় সে ধরনের তৎপরতা তেমন লক্ষ করা যায়নি। কোথাও কোথাও রাজনৈতিক নেতারা ত্রাণসহায়তার নামে ফটোসেশন করেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেন।
উত্তরাঞ্চলে কোথাও কোথাও এখনো পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দুর্গত এলাকায় প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো জরুরি। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় গোখাদ্যেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে আমন মৌসুম হওয়ায় যেসব কৃষক সময়মতো চাষাবাদ শুরু করতে পারেননি, তাঁদের কথাও ভাবতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে তাঁরা চাষাবাদ শুরু করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করতে হবে সরকারকে। যাঁদের বীজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাঁদের বীজ সরবরাহ করতে হবে।
বন্যা বাংলাদেশের একটি স্থায়ী সমস্যা। প্রতিবছরই কোনো না কোনো অঞ্চলে বন্যার প্রকোপ দেখা দেয়। বন্যা সমস্যার সমাধানের জন্য যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। উজান থেকে আসা ঢল যাতে দ্রুত নেমে যেতে পারে, সে জন্য নদীর নাব্যতা বাড়াতে হবে, জলাশয় ও খালগুলোর দূষণ ও দখল বন্ধ করতে হবে। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর দুই পাড়ে ভাঙন দেখা দেওয়ায় অনেকে বসতবাড়ি হারিয়েছেন, তাঁদের পুনবার্সনের কাজ জরুরি ভিত্তিতে শুরু করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
আবহাওয়াবিদদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, এ বছর বৃষ্টি বেশি হবে। অতএব সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে। ত্রাণ ব্যবস্থাপনা আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে।