৭ জানুয়ারির আগের ও পরের রাজনৈতিক দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সময়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জনের কর্মসূচি নিয়েছিল। তাদের সেই কর্মসূচিতে যাতে নির্বাচন বানচাল না হয়ে যায়, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নির্বিচার আটক করা। এ ক্ষেত্রে সরকারের হাতে প্রধান বর্ম ছিল ‘নাশকতা’ ও নির্বাচনবিরোধী তৎপরতা।
এসব মামলার আইনি ভিত খুব জোরালো নয়। অনেক ক্ষেত্রে নেতা-কর্মীদের আটক করার পর মামলা দেওয়া হয়েছে কিংবা পুরোনো মামলায় তঁাদের যুক্ত করা হয়েছে। আবার কোথাও ঘটনা ঘটতে পারে, এই ধারণা থেকেও তাঁদের আটক করা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও গায়েবি মামলার হিড়িক পড়েছিল।
২২ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের তিন মাসে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ২৩৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয় সাড়ে পাঁচ হাজার নেতা-কর্মীকে। বেশির ভাগ মামলার বাদীও পুলিশ।
বিএনপির দলীয় সূত্র বলছে, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতি জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সারা দেশে তাদের ২৭ হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় ঢাকার বিভিন্ন থানায় মামলা হয় ৩৬টি। এসব মামলায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলটির বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের নেতা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ২৮ অক্টোবর যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেছে, তা অগ্রহণযোগ্য। সেই ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহাসচিবসহ বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে আটক রাখার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। প্রকৃত অপরাধীদের ধরে বিচারে সোপর্দ করা আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের আটক করা এক কথা নয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। তাঁর এই বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতখানি? বিএনপি নেতাদের দাবি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতা-কর্মীদের রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করতে সরকার একের পর এক মামলা ও গ্রেপ্তার করেছে। যাঁরা এখন রাজনৈতিক মামলার পক্ষে আইনের দোহাই দিচ্ছেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অভিযোগকে স্বতঃসিদ্ধ বলে দাবি করছেন, তাঁরাও বিরোধী দলে থাকতে একইভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
একটি দলের মহাসচিব হুকুম দিয়ে সমাবেশ পণ্ড করতে পুলিশের ওপর হামলা চালানোর নির্দেশ দেবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সরকারের অভিযোগ, বিএনপির নেতৃত্ব নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নির্বাচন তো হয়ে গেছে। নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। নতুন সংসদের অধিবেশনও বসতে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যেসব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই, তাঁদের কেন আটক রাখা হবে?
সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখ থেকেও নতুন সরকারের সামনে রাজনৈতিক, বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথা শোনা গেছে। পশ্চিমের যেসব দেশ নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে, তারাও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিয়ে সরকার অন্তত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার পরিবেশ তৈরি করতে পারে।