নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে—এ খবর স্বস্তিদায়ক হলেও আমরা আনন্দিত হতে পারি না। কেননা নারী-পুরুষের সমতায় এগিয়ে থাকা দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২২-এ ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১। গত বছর ১৫৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৫। অন্যদিকে তালিকার শীর্ষে আছে আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড ও সুইডেন। এসব দেশের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু নারী-পুরুষের সমতায় তারাও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
অর্থনীতিতে নারীর সম্পৃক্ততা ও সুযোগ, শিক্ষা খাতে অর্জন, স্বাস্থ্যসেবা ও রাজনীতিতে অবস্থান—এ চার বিষয়ে নারীর ক্ষমতায়ন নিরূপণ করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে থাকলেও গত বছর থেকে আমরা সাত ধাপ পিছিয়ে আছি। অন্যান্য সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ধারাবাহিক নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক পা এগোই তো দুই পা পেছনে যাই। ২০২১ সালে শিক্ষা ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় আমাদের যে অগ্রগতি ছিল, তা থেকে পিছিয়ে পড়েছি। যদিও অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে সামান্য এগিয়ে আছি। গত বছর এই দুটোতে আমাদের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১৪৭ ও ১৩৪তম। এবার ১৪১ ও ১২৯। এটা নিশ্চয়ই অগ্রগতি।
বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সমতার অন্যতম ভিত্তি শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশটির নির্বাহী প্রধানের পদে নারী আছেন (মাঝখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর বাদে)। জাতীয় সংসদের স্পিকার ও বিরোধী দলের নেতাও নারী। সে ক্ষেত্রে রাজনীতিতে নারী-পুরুষের সমতার ক্ষেত্রে আরও সামনে এগোনোর কথা। কিন্তু পূর্বাপর সরকারগুলো গতানুগতিক ধারায় চলায় কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় পর্যায়ে আমরা সরাসরি ভোটে নারী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করছি। কিন্তু জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০ আসনে নির্বাচন হচ্ছে পরোক্ষ ভোটে। এর মাধ্যমে তঁাদের ক্ষমতা অনেকটা হ্রাস করা হয়েছে।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের আরেকটি ভিত্তি ছিল শিক্ষা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীর অনুপাত প্রায় সমান ছিল। পরীক্ষার ফলাফলেও তারা এগিয়ে থাকে। এটা অবশ্যই আশার কথা। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাদের সে রকম উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না।
করোনাকালে শিক্ষায়ও মেয়েরা পিছিয়ে গেছে। বিশেষ করে বাল্যবিবাহের কারণে অনেক মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। একটিতে পিছিয়ে থেকে অপরটিতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নারী ও পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সমাজের সর্বস্তরে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বাল্যবিবাহ নিয়ে আসতে হবে শূন্যের কোঠায়।
নারী-পুরুষের সমতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে আছে; এটা সান্ত্বনা পুরস্কার পাওয়ার মতো। আমাদের এখানে থেমে থাকলে চলবে না। যেতে হবে আরও বহু দূর। শীর্ষে থাকা দেশগুলোর সঙ্গেই আমাদের পাল্লা দিতে হবে। আমরা যদি সত্যি সত্যি নারী-পুরুষের সমতা চাই, রাষ্ট্রের যে পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর্থসামাজিক বাধাগুলো দূর করতে হবে সাহসের সঙ্গে।