রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার কতগুলো নীতি ঘোষণা করে এবং তার ভিত্তিতে আইন প্রণীত হয়। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি যে সরকার অনেক বিষয়ে ভালো ভালো নীতি ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এ প্রসঙ্গে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০০৯ সালের জাতীয় নারী নীতি কিংবা ২০১৫ সালে ঘোষিত গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতির কথা উল্লেখ করা যায়।
প্রথম দুটি নীতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হলেও তৃতীয়টি থেকে গেছে অন্তরালে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের গবেষণায় দেখা যায়, ৯৯ শতাংশ গৃহকর্মী এবং ৬৬ শতাংশ নিয়োগকর্তা গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি সম্পর্কে কিছু জানেন না। অন্যদিকে বাসাবাড়িতে কাজ করতে গিয়ে মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হন ৬৭ শতাংশ গৃহকর্মী। জাতীয় গৃহকর্মী নীতিতে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিষয়ে সাহায্য চাওয়ার কথা বলা আছে। যদিও হটলাইন, হেল্পলাইন সম্পর্কে সচেতন নন ৯১ শতাংশ গৃহকর্মী।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, দারিদ্র্য, পেশার সহজলভ্যতা, বিবাহবিচ্ছেদের কারণসহ বিভিন্ন কারণে গৃহকর্মীর কাজ বেছে নেন নারীরা। কিন্তু এই পেশায় এসে ৪২ শতাংশ আবাসিক কর্মী বসার ঘর কিংবা রান্নাঘরের মতো খোলা জায়গায় ঘুমান। ৯৬ শতাংশ গৃহকর্মী বলেছেন, তাঁদের বর্তমান মজুরি মৌলিক চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। শতভাগ গৃহকর্মীই মৌখিক চুক্তির মাধ্যমে কাজ করেন। আবাসিক গৃহকর্মীরা দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। খণ্ডকালীন গৃহকর্মীদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পান না। এ ছাড়া ৯৯ শতাংশ গৃহকর্মীই পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে কোনো প্রশিক্ষণ পান না। মাত্র ৪ শতাংশ গৃহকর্মী কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকেন।
জাতীয় গৃহকর্মী সুরক্ষানীতি ঘোষণার সাত বছর পরও এসব তথ্য আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অমার্জনীয় অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার কারণে লাখ লাখ গৃহকর্মীকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এ অবস্থার উত্তরণ প্রয়োজন।
দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করানো কিংবা সাপ্তাহিক ছুটি না দেওয়া আইএলও কনভেনশন কিংবা দেশের আইনেরও পরিপন্থী। মনে রাখতে হবে, যাঁরা গৃহকর্মীদের নিয়োগ করেন, তাঁরাও আইনের ঊর্ধ্বে নন। যদি জাতীয় গৃহকর্মী সুরক্ষানীতি বাস্তবায়নই না হবে, তাহলে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হলো কেন? সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর, স্থানীয় সরকার সংস্থার যে দায়িত্ব ছিল, সেটা তারা পালন করেনি বলেই গৃহকর্মীরা এ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। আমাদের দেশে অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন আছে, তারাও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু ‘লাভজনক’ প্রকল্পের দিকে বেশি মনোযোগী।
যে সরকার প্রতিনিয়ত মানবসম্পদের বিপুল উন্নয়নের বয়ান শোনাচ্ছে, সেই সরকারের আমলে গৃহকর্মীরা অমানবিক ও অমর্যাদাকর জীবন যাপন করবেন, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। মানুষ হিসেবে তাঁদের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হোক। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার এসডিজি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এসডিজির মূল লক্ষ্য কাউকে পেছনে ফেলে নয়। কিন্তু লাখ লাখ গৃহকর্মীকে অমানবিক পরিবেশে রেখে সেটি যে সম্ভব নয়, তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
বিলম্বে হলেও গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি বাস্তবায়নে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে আশা করি।