চিনির দাম নিয়ে ব্যবসায়ী ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হলেও বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না। কখনো সরকার এক ধাপ পেছায় তো ব্যবসায়ীরা দুই ধাপ এগোন। কিন্তু সরকার-নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে ভোক্তাকে চিনি কিনতে হচ্ছে। চড়া দামের কারণে চিনির স্বাদ যেন তেতো হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, মিলমালিকেরা বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে চিনির দাম আরও বাড়িয়ে দিতে চাইছেন। গত সোমবার বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছিল, ২২ জুন থেকে তারা প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১৫০ টাকা ও খোলা চিনি ১৪০ টাকা দরে বিক্রি করবে। সংগঠনটি বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে (বিটিটিসি) নতুন দরের কথা জানিয়ে চিঠিও দিয়েছিল।
এরপরই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নড়েচড়ে বসেন। গত মঙ্গলবার বিটিটিসি মিলমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে পবিত্র ঈদুল আজহার আগে চিনির দাম বাড়ানো হবে না। ঈদের পরে বিটিটিসির সঙ্গে এ নিয়ে মিলমালিকেরা ফের বৈঠক করে দাম সমন্বয় করবেন। বিটিটিসি বলেছে, এর আগে শুল্কছাড়ে যে চিনি আনা হয়েছিল, তা এখনো বাজারে আছে। সে ক্ষেত্রে চিনির দাম এ মুহূর্তে বাড়ানোর যুক্তি নেই।
চিনির বাজার অনেক দিন ধরেই অস্থিতিশীল। বাজারে বর্তমানে সরকারিভাবে খুচরায় প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা ও খোলা চিনির দাম ১২০ টাকা বেঁধে দেওয়া আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে।
বিটিটিসি জানায়, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। অপরিশোধিত চিনির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি বেড়েছে ৩৩ শতাংশ, কিন্তু দেশের বাজারে বেড়েছে ৫৮ শতাংশ। এর অর্থ, যে হারে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বেড়েছে, দেশীয় বাজারে বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। ২০২২ সালের ৮ জুন আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ছিল টনপ্রতি প্রায় ৫৫২ মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালের ৮ জুন তা বেড়ে হয় ৬৭৩ ডলার।
দেশে চিনির বাজারের এই ঊর্ধ্বগতির পেছনে বিশ্ববাজারের দাম ছাড়াও অন্য কারণ আছে। সরকার স্থানীয় শিল্প রক্ষার নামে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ককর ৬২ শতাংশ ও পরিশোধিত চিনির আমদানি কর ৬৭ শতাংশ ধার্য করেছে। বাস্তবতা হলো, স্থানীয়ভাবে যে চিনি উৎপাদিত হয়, তাতে চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ পূরণ হয়। এ ছাড়া চিনির দাম বাড়ার পেছনে সাম্প্রতিক ডলার–সংকট, সময়মতো জাহাজ থেকে চিনি খালাস না হওয়া ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিকেও দায়ী করেছেন বাজারবিশেষজ্ঞরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনি আমদানির শুল্ককর কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সম্প্রতি চিঠি দেয়। তবে শুল্কছাড় অব্যাহত রাখা হয়নি। ফলে ১ জুন থেকে শুল্ক–কর বেড়ে গেছে।
যেসব দেশে আখ উৎপন্ন হয় না, সেসব দেশে চিনি আমদানির যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ আখ উৎপন্ন হওয়ার পরও চিনির জন্য প্রায় পুরোপুরি আমদানিনির্ভরতা সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। যুগের দাবি অনুযায়ী, চিনিকলগুলো সংস্কার না করে লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জ্বালানিসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে সরকারের এই আমদানিনির্ভরতা নীতি ভোক্তাদেরই পকেট কাটছে না, দেশের অর্থনীতিকেও বিপাকে ফেলছে।
ভোগ্যপণ্যের আমদানির বিষয়ে সরকারের টেকসই কোনো নীতি-পরিকল্পনা আছে বলেও মনে হয় না। তারা কখনো শুল্ক কমিয়ে, কখনো বাড়িয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চায়। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ভোক্তাদের পকেট কাটা যায়। চিনির বাজার স্থিতিশীল রাখতে আমদানি শুল্ক অবশ্যই কমাতে হবে। সেই সঙ্গে বাজার তদারকিও জোরদার করতে হবে, যাতে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কেউ চিনি বিক্রি করতে না পারেন।