শিক্ষকদের সাত দফা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা চললেও প্রশাসন সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি। ফলে পরিস্থিতি এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে যে সিন্ডিকেটের জরুরি বৈঠক ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা ও শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ দিতে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী সংস্থার এই নির্দেশেও অচলাবস্থার অবসান হয়েছে, তা বলা যাবে না। অধিকাংশ শিক্ষার্থী হলেই অবস্থান করছেন এবং গত ৩০ এপ্রিল ও ১ মে তাঁরা ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবিতে। শিক্ষার্থীদের কথা হলো, উপাচার্য ও শিক্ষকদের বিরোধের কারণে কেন তাঁদের পড়াশোনা ব্যাহত হবে? ঈদের ছুটির পর তাঁরা হলে এসেছেন মাত্র। এ অবস্থায় তাঁদের আবার হল ত্যাগ করতে বলা অযৌক্তিক ও অমানবিক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষক সমিতির প্রশাসনিক বিষয়, তথা শিক্ষকদের পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই সেটি সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন মানতে হবে। জোর করে যেমন অন্যায় দাবি আদায় করা যাবে না, তেমনি স্বেচ্ছাচারী কায়দায়ও বিশ্ববিদ্যালয় চালানো যাবে না। যদিও আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ উপাচার্য একক কর্তৃত্বে প্রশাসন চালাতে চান।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাত দফার মধ্যে কিন্তু উপাচার্যের পদত্যাগের কথা ছিল না। এটি এসেছে, যখন উপাচার্য তাদের কোনো দাবিকে আমলে নেননি এবং তাঁদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়েছেন। উপাচার্যের একগুঁয়েমি মনোভাবের প্রতিবাদে প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকেও অনেক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষকদের বিরোধ ধাক্কাধাক্কি বা শক্তি প্রদর্শনের পর্যায়ে চলে গেছে। এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা পর্যন্ত করেছে। এই হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ও শিক্ষকদের নৈতিক মান। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এত দিন ছাত্রসংগঠনগুলো দখলদারি করে আসছিল। এখন সেই দায়িত্ব উপাচার্য ও শিক্ষকেরাই নিয়েছেন। এর চেয়ে লজ্জার ঘটনা আর কী হতে পারে?
উপাচার্য নিজেও একজন শিক্ষক। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিগুলো তাঁর আমলে নেওয়া উচিত ছিল। এমনকি কোনো দাবি অযৌক্তিক মনে হলে সেটাও তাঁদের বুঝিয়ে বলতে পারতেন। তা না করে তিনি যখন ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে ক্যাম্পাসে দল ভারী করতে থাকেন, তখন সাধারণ শিক্ষকেরা ক্ষুব্ধ হবেনই। উপাচার্য আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিলে ক্যাম্পাসে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো যেত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। উপাচার্য কেন ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে ক্যাম্পাসে আসবেন? বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সংগঠনটির কমিটিও নেই। কারও জেদ বা স্বেচ্ছাচারিতার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হতে পারে না। কয়েক দিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সতীর্থদের আন্দোলনের মুখে প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। আমরা মনে করি, সেটাও ঠিক হয়নি।
আর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো শিক্ষার্থীদের কোনো দায়ই ছিল না। তাহলে তাঁদের ক্লাস-পরীক্ষা কেন বন্ধ থাকবে? হল বন্ধ করার কারণ হিসেবে প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, সেখানে ‘অস্ত্র’ আছে। তাহলে প্রশাসন কি অস্ত্রধারীদেরই এত দিন হলে থাকার ব্যবস্থা করেছিল? নিজেদের অন্যায়ের দায় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে আত্মরক্ষার অপকৌশল নিয়েছে, পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। অবিলম্বে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হোক।
উপাচার্য ও শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকতে পারে না। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।