সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

নদী ভরাট করে আবাসিক প্রকল্প

আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য হলো কেন

বরিশালের বানারিপাড়ায় সন্ধ্যা নদীর (কৃষ্ণকাঠি) সীমানা জরিপ ও নদীর জায়গায় থাকা দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পাঁচ বছর আগে দেওয়া রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় উচ্চ আদালতের অসন্তোষ প্রকাশ অযৌক্তিক নয়।

২৮ মে শুনানিকালে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে বলেছেন, রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে কত দিন লাগবে? ১০০ বছর হলেও হয়তো হবে না।

সন্ধ্যা নদী ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে জনস্বার্থে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) ২০০৯ সালে হাইকোর্টে রিট করে।

রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ রায় দেন। নির্দেশনার মধ্যে সিএস ও আরএস রেকর্ড অনুসারে একই বছরের ৩১ মের মধ্যে নদীর সীমানা জরিপ করতে ও জরিপ অনুসারে নদীর জায়গায় থাকা স্থাপনা চার মাসের মধ্যে উচ্ছেদ করতে বলা হয়।

আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি উল্লেখ করে এইচআরপিবি গত ফেব্রুয়ারিতে সম্পূরক একটি আবেদন করে। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জুলফিয়া আক্তার। মামলার শুনানিকালে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে বলেন, ‘আমেরিকা নিচ্ছে না, আটকে দিচ্ছে। দেশ এটিই—এটার মধ্যে থাকতে হবে। সব লুট করে নিয়ে যাবেন, সব আটকে রেখে দেবে। ভালো করে বুঝিয়ে বলেন দেশের পরিবেশ ঠিক রাখার জন্য। সময় দিচ্ছি, না পারলে আপনার ডিসি সাহেব এসে আদালতে বলবেন।’ পরে আদালত আগামী ১৮ জুন পরবর্তী তারিখ রাখেন।

আদালতের এই উদ্বেগ ও ভর্ৎসনার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। ১৪ বছর পরও সন্ধ্যা নদী ভরাটের বিরুদ্ধে করা মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে লিভ টু আপিল করা সময়ক্ষেপণ ছাড়া কিছু নয়। নদী জনগণের সম্পত্তি। এটি রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। সন্ধ্যা নদী ভরাট হওয়ার পরপরই স্থানীয় প্রশাসনের উচিত ছিল দখলমুক্ত করা, সেটি তারা করেনি। এরপর উচ্চ আদালতের রায়ও তারা নানা অজুহাতে লঙ্ঘন করে চলেছে। দখলদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই প্রশাসন এই ভূমিকা নিয়েছে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

উচ্চ আদালত অন্য যে বিষয়টির প্রতি রাষ্ট্রপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, সেটি হলো বিদেশে লুটের অর্থ পাচার করে লাভ নেই। কেননা তারা সেটি আটকে দিচ্ছে। আটকে দিক আর না-ই দিক, দেশের অর্থ ও সম্পদ বিদেশে যাঁরা পাচার করেন, তাঁরা দেশ ও জাতির শত্রু। সরকার কথায় কথায় শত্রু খোঁজে। কিন্তু প্রকৃতই যারা শত্রু, তাদের টিকিটিও ধরতে পারে না বা ইচ্ছা করে ধরে না।

আদালত যথার্থই বলেছেন, পরিবেশ ও জনগণের সম্পত্তি রক্ষা করতে হবে। দেশের সম্পদ দেশেই রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। একশ্রেণির মানুষ বিদেশে সেকেন্ড হোম করছেন। বৈধভাবে কেউ সেটি করলে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু তঁারা তো এসব অর্থ বৈধভাবে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন না।

কেবল সন্ধ্যা নদী নয়, দেশের অনেক নদীই প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। নদী ভরাট করে সড়ক ও স্থাপনা নির্মাণ, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রকল্প স্থাপনের নজিরও আছে।

এগুলো দেখার বা বন্ধ করার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা কখনো নাকে তেল দিয়ে ঘুমান, কখনো দখলদারদের সহায়তা করেন। সরকারি কর্মকর্তারা যত বড় পদেই থাকুন, আদালতের নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে পারেন না।

আমরা আশা করব, আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সন্ধ্যা নদীর জরিপ শেষ করে নদী দখলমুক্ত করা হবে।