অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে; যাতে ইতির চেয়ে নেতির পাল্লাই ভারী।
অর্থমন্ত্রী এমন সময়ে বাজেট পেশ করলেন, যখন দেশের অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নমুখী, মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে সীমিত আয়ের মানুষ বিপর্যস্ত। তিনি তাঁর বাজেট বক্তৃতায় সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর বাজেট বক্তৃতায় খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যায় না। সাধ ও সাধ্যের বিস্তর ফারাক আছে। এ কথা ঠিক অর্থমন্ত্রী কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি নিয়েছেন। পূর্বসূরির মতো বাজেটের অঙ্গ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামেননি।
নতুন অর্থবছরের জন্য তিনি ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। একই সময়ে আয়ের প্রাক্কলন হচ্ছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এতে সামগ্রিক ঘাটতি হবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় ঘাটতি ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
বাজেটে করপোরেট কর কমানো হয়েছে, এতে শিল্পোদ্যোক্তারা উৎসাহিত হতে পারেন। ৩৪টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এতে আমদানি পণ্যের দাম কমবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। নিকট অতীতে এমনও দেখা গেছে, কোনো পণ্যের শুল্ক কমানোর পরও তার দাম কমেনি।
তবে অর্থমন্ত্রী খরচের ক্ষেত্রে যত হিসাবিই হোন না কেন, অর্থ কোথা থেকে আসবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। বাজেটে যে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি, সেটা পূরণ করতে সরকারকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ করতে হবে। ব্যবসায়ীরা যৌক্তিকভাবেই দেশি উৎস থেকে ঋণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, সরকার ব্যাংক খাত থেকে বেশি টাকা নিয়ে গেলে বেসরকারি খাত ঝুঁকিতে পড়বে।
বাজেটে ল্যাপটপ, গুঁড়া দুধ, ডায়ালাইলিস সেবা, ডেঙ্গুর কিটের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে, এটা ভালো পদক্ষেপ বলে মনে করি। কিন্তু বিদেশি পোশাকের ওপর সম্পূরক শুল্ক কমানোর যুক্তি আছে বলে মনে করি না। একইভাবে অর্থমন্ত্রী ও সিগারেট কোমল পানীয়র ওপর শুল্ক বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা সমর্থনযোগ্য। বাজেটে বিদেশি পানির ফিল্টারের শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তার আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত যে তারা কেন সুপেয় পানি সরবরাহ করতে পারছে না।
অর্থনীতিবিদদের দাবি ছিল, কর খাতের সংস্কারের মাধ্যমে করের আওতা বাড়ানো। কিন্তু সরকার সেই পথে না গিয়ে যাঁরা কর দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর বোঝা বাড়ানোর নীতি নিয়েছেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে যা নিয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে, তা হলো কালোটাকা সাদা করা। সরকার কর ফাঁকিবাজদের বিশেষ সুবিধা দিলেও সৎ করদাতাদের সঙ্গে বৈষম্য করতে পারে না। তাঁরা সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ কর দিচ্ছেন, আর কালোটাকাওয়ালারা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে পার পাবেন, এটা কেবল বৈষম্যমূলক নয়, অনৈতিকও। বাজেট প্রস্তাবের আরেকটি সমালোচনা হলো শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমানো। চলতি অর্থবছরে যেখানে জিডিপির ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ ছিল, সেটা কমিয়ে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও বিরোধী রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে বাজেটের যেসব সমালোচনা এসেছে, অর্থমন্ত্রী সেগুলো তুড়ি মেরে উড়িয়ে না দিয়ে বাস্তবধর্মী সংশোধনের উদ্যোগ নিলে সেটা দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে বলে মনে করি।