সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

এই পরিবর্তন ফলপ্রসূ হোক

জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো শাসকই যে টিকতে পারেন না, বাংলাদেশে আবারও তা প্রমাণিত হলো। ২০০৯ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিতে হলো অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে। শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা গণ–আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এই পরিবর্তনকে একটি দীর্ঘস্থায়ী ফলপ্রসূ করে তোলাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন সহজেই সামাল দেওয়া যেত, তাকে এমন একটি সহিংস পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়ার পেছনে যা কাজ করেছে, তা হচ্ছে সরকার ও বিশেষ করে সরকারপ্রধানের একগুঁয়ে আচরণ। এর কারণে কোটা সংস্কারের মতো একটি নিরীহ ও অরাজনৈতিক আন্দোলনে তিন শতাধিক মানুষকে জীবন দিতে হলো, মূল্যবান রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হলো।

যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির চেয়ে দল বড় এবং দলের চেয়ে দেশ বড় হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা নিজেকে দল ও দেশের ঊর্ধ্বে ভাবতেন এবং তাঁর গত ১৫ বছরের শাসনে প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও দেশ ও দলের চেয়ে ব্যক্তি হিসেবে তাঁর একক কর্তৃত্বই দেখা গেছে।

পদত্যাগ ও দেশত্যাগের আগের দিনও শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন দমনে দলের লোকজনকে অস্ত্রশস্ত্রসহ নামিয়ে দেশজুড়ে যে সহিংসতা ঘটালেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কলঙ্কজনক ঘটনার দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। এই আন্দোলনে ২১৩ জনের মৃত্যুর পরও যদি তিনি সংযত হতেন, তাহলে সেদিন ১৪ জন পুলিশ সদস্যসহ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি এড়ানো যেত। এই দায় থেকে তিনি কোনো দিন মুক্তি পাবেন না।

শুরুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও সরকার এই আন্দোলন দমনে যত নিষ্ঠুর ও কঠোর হয়েছে, ততই জনসমর্থন বেড়েছে এবং একপর্যায়ে তা আর সেখানে আটকে থাকেনি। ব্যাপক জনসম্পৃক্ততার এক পর্যায়ে তা সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়।

কারণ, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনে তিন মেয়াদে জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সেই সঙ্গে দলের লোকজনের সীমাহীন দুর্নীতি, বিচারহীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও কার্যত একদলীয় শাসন কায়েমের মাধ্যমে দেশজুড়ে যে ভয়ের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল, তা থেকে মানুষ মুক্তির পথ খুঁজছিল। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সেই সুযোগ করে দেয়।

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পর এখন দেশে আইনানুগ কোনো সরকার নেই। একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আমরা মনে করি, আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি, নাগরিক সমাজ ও সংবিধানবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কাজটি দ্রুত করতে হবে।

একটি গ্রহণযোগ্য সরকার গঠনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থায়ী রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পথ তৈরি করা গেলে এই পরিবর্তনকে ফলপ্রসূ করা সম্ভব হবে।

এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে। আমরা আশা করব, বৈষম্যে মুক্তির বিষয়টি সামনের দিনগুলোতে গুরুত্ব পাবে। সেই সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের একটি কার্যকর ব্যবস্থা কায়েমের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

গত কয়েক দিনের আন্দোলনে যে তিন শতাধিক প্রাণ গেছে, তাঁদের পরিবারের প্রতি রইল আমাদের গভীর সমবেদনা। ছাত্র–জনতার এই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাই। তাঁরা তাঁদের ত্যাগ ও সংগ্রাম দিয়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন, তা যাতে কেউ নস্যাৎ না করতে পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।