সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

ভূমিদস্যুদের শক্তি-সামর্থ্য

দখলদারির বিরুদ্ধে শুধু কথা বলা যথেষ্ট নয়

‘কিছু করতে গেলেই ভূমিদস্যুরা মামলা করে দেন’ বলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম যে মন্তব্য করেছেন, তাতে ঢাকা শহরের অবৈধ ভূমি দখলের নির্মম চিত্রের পাশাপাশি তাঁর অসহায়ত্বও প্রকাশিত হয়েছে।

২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বধ্যভূমিসংলগ্ন এলাকায় ‘মুক্তির সবুজায়ন’ শীর্ষক বৃক্ষরোপণ প্রকল্পের উদ্বোধনকালে মেয়র বলেন, ‘ভূমিদস্যুরা টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে নেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।’ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অন্যতম স্থান ‘মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি’কে কেন্দ্র করে একটি আধুনিক ও সবুজ শিশুবান্ধব গণপরিসর গড়ে তুলতে উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বেসরকারি সংগঠন শক্তি ফাউন্ডেশন এবং মেটলাইফ ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় জল্লাদখানা স্মৃতিসৌধের বিপরীতে পরিত্যক্ত জমিতে এক হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। জল্লাদখানা ও এর পাশের গণপরিসরটিকে আগামী দুই বছর রক্ষণাবেক্ষণ করবে শক্তি ফাউন্ডেশন।

যেখানে ঢাকা শহরে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে, একের পর এক মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে এ কথাও বলব যে বিক্ষিপ্তভাবে সবুজ প্রকল্প নিলে খুব লাভ হবে না, গোটা ঢাকা শহর পরিকল্পিতভাবে সবুজায়ন করতে হবে। নগরবিদদের মতে, একটি আদর্শ নগরের ২২ শতাংশ সবুজ থাকা দরকার, ঢাকা শহরে আছে মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশ।

মেয়র বলেছেন, ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। কথা অবশ্যই বলতে হবে। কিন্তু যাঁরা টাকা দিয়ে সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শুধু কথা বললেই হবে না। যেসব ভূমি, খাল, লেক ও পার্ক ইতিমধ্যে ভূমিদস্যুরা দখল করেছেন, অবিলম্বে সেগুলো উদ্ধার করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে পাহারা দিতে হবে, যাতে তাঁরা নতুন করে কোনো সরকারি-বেসরকারি জমি দখল করতে না পারেন।

মেয়র নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, সরকারি অফিসের লোকজনের সহায়তায়ই ভূমিদস্যুরা দখলের কাজটি করে থাকেন। কেবল সরকারি অফিসের লোক নন, তাঁরা স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও ম্যানেজ করে থাকেন। অতএব ভূমিদস্যুদের ঠেকাতে হলে এই ত্রিচক্রের আঁতাতও ভেঙে দিতে হবে।

আইনে আছে কোনো ব্যক্তি সরকারি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভূমি বা স্থাপনা অবৈধভাবে দখল করলে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে পারবেন। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে তিনি দুই বছরের কারাদণ্ডে বা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বাস্তবতা হলো ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না, উল্টো তাঁরাই মামলা করে নিজেদের দখলদারি টিকিয়ে রাখেন।

মেয়র শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় খেলার মাঠ, পার্ক ও উন্মুক্ত স্থান রাখার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মিরপুরে বালুর মাঠ ও কলাবাগানে তেঁতুলতলার মাঠ রক্ষা পেয়েছে। এটা ভালো উদাহরণ। কিন্তু ঢাকা শহরে এ রকম অনেক মাঠ ও পার্ক দখল হয়ে গেছে। বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করার কারণে অনেক মাঠ ও লেক সৌন্দর্য হারাচ্ছে। সম্প্রতি প্রথম আলোয় ধানমন্ডি লেক নিয়ে সরেজমিনে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে।

মেয়র আতিক ভূমিদস্যুদের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তুলনা করাই যথেষ্ট নয়। এঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে দখল করা জমি উদ্ধার করতে হবে। আমাদের শিশুদের জন্য অবশ্যই ভালো কিছু রেখে যেতে হলে সিটি করপোরেশনসহ সব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে।