সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

কাঠচোর চক্রকে থামান, বন বাঁচান

সুন্দরবনকে বলা হয় প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবেষ্টনী। অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বুক আগলে জনপদগুলো বাঁচানোর অসংখ্য উদাহরণ আছে তার। সম্প্রতি রিমাল ঘূর্ণিঝড়েও সেটিই আমরা দেখলাম। একই অঞ্চলে আরেকটি ম্যানগ্রোভ বন হচ্ছে টেংরাগিরি। বরগুনায় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে এ বনকে বলা হয় দ্বিতীয় সুন্দরবন। দেশে আরেকটি সুন্দরবন ছিল কক্সবাজার অঞ্চলে। সেটি অনেক আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন টেংরাগিরিও ধ্বংস হওয়ার মুখে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র বনটিকে উজাড় করে ফেলছে। দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এ সুন্দরবনকেও আমাদের অচিরেই হারাতে হবে।

টেংরাগিরি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। তবে ষাটের দশকের শেষের দিকে এটি আলাদা বন হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায়। তালতলী থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বনাঞ্চলের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। বড় নিশানবাড়িয়া ও সখিনা দুটি বিট নিয়ে গঠিত এই বনাঞ্চল প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের অমূল্য এক আধার। অন্যান্য গাছ থাকলেও সুন্দরী ও গরানগাছের জন্য আলাদাভাবে পরিচিতি আছে টেংরাগিরির।

তবে টেংরাগিরি বন বেশি দিন টেকে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সংঘবদ্ধ কাঠচোরেরা এ বনকে যেভাবে উজাড় করে ফেলছে, তা খুবই ভয়াবহ। তাদেরকে কোনো বাধা দেওয়া হয় না। বাধা দিলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। মামলা হলে আবার শাস্তি হয় না। ফলে কাঠচোর চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দুই দশক ধরে টেংরাগিরির ওপর এ অত্যাচার চলছে। তার মানে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়ে গেছে বনাঞ্চলটির।

টেংরাগিরি ধ্বংস করা হচ্ছে দুটি পদ্ধতিতে, প্রকাশ্যে গাছ কেটে ও বনে আগুন লাগিয়ে। এ আগুন লাগানোর ঘটনাও ঘটছে ১৫–২০ বছর ধরে। মূলত বনের গাছ কেটে পাচারের পর আলামত ধ্বংস করতে আগুন দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। গত মার্চ মাসে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সেখানে ঘটে। আগুনে সাগরতীর থেকে আধা কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত বনের গাছ পুড়ে যায়। সেখানে অন্তত তিন হাজার গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। আগুনে পুড়েছে অন্তত ১০ হাজার গাছ। অসংখ্য গাছ আগুনে শুকিয়ে গেছে। তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিফাত আনোয়ার নিজেও স্বীকার করেছেন, বনের গাছ নিয়ে হরিলুট চলছে। সে জন্যই এ আগুন লাগানো হয়েছে।

জানা যাচ্ছে, বনটির কাঠ পাচারকে কেন্দ্র করে সক্রিয় কলাপাড়ার চারটি চক্র। তাদের সঙ্গে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগও গেছে। আসলেই বন বিভাগের লোকজনের যোগসাজশ ছাড়া বছরের পর বছর একটি বনকে কীভাবে খুবলে খাওয়া সম্ভব? চক্রগুলো বনের ভেতরে ঢুকে প্রথম নির্বিচার গাছ কাটে। পরে রাতে ট্রলার ভর্তি করে সেসব কাঠ পাচার হয়ে যায় ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়। এসব চক্রের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা আছে বন বিভাগের। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মামলায় কারও শাস্তি হয়নি।

বনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবনের মতোই আরেক আশীর্বাদ এই টেংরাগিরি বন। ঘূর্ণিঝড় থেকে এ বনও সেখানকার জনপদগুলোকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে এ বন সংরক্ষণের পাশাপাশি পরিধি বাড়ানো জরুরি।

কক্সবাজার অঞ্চলের সুন্দরবনকে সত্তর-আশির দশকে চিংড়ি চাষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর সেই বন ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জ নামের সেই বনাঞ্চলের কথা এখন অনেকেই জানেন না। কাঠচোর চক্রকে থামানো না গেলে একদিন হয়তো টেংরাগিরি নামের আরও একটি সুন্দরবন ছিল, সেটিও আমরা ভুলতে বসব। এখানে জনবল ও যানবাহন–সংকটের নামে বন বিভাগের দায়িত্বে অবহেলা ও উদাসীনতা মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। অনিয়মকারীদেরও কোনোভাবে ছাড় দেওয়া যাবে না। জেলা–উপজেলার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। এ বন রক্ষায় তাদেরও বড় দায় আছে।