সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী

সরকারি মজুত ও সরবরাহ বাড়ানো হোক

স্বাধীনতার পর সব সরকারই জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে এবং এ ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের সাফল্য অনেক বেশি। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বাংলাদেশের এই সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ বিষয়ে মনোযোগ কম বলে জানা গেছে। তাঁরা ‘জনসংখ্যাকে জনসম্পদ’ হিসেবে গণ্য করে এর লভ্যাংশ নেওয়ার কথা ভাবছেন।

বর্ধিত জনসংখ্যা তখনই মানবসম্পদে রূপ নেবে, যখন প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা তথা মানসম্মত খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামো সেই অবস্থান থেকে এখনো অনেক দূরে। অতএব জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি জোরদার রাখার বিকল্প নেই। যাঁরা সমাজের বিত্তবান ও সচেতন অংশ, তাঁদের কাছে জনসংখ্যানিয়ন্ত্রণসামগ্রী পৌঁছানোর দরকার নেই। তাঁরা বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে এ সেবা কিনে নিতে পারবেন। কিন্তু যাঁরা দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ, তাঁদের কাছে বিনা মূল্যে এসব সামগ্রী পৌঁছানো জরুরি।

২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় এ বিষয়ে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এতে বলা হয়, মাঠপর্যায়ে সরকারের দেওয়া জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সংকট আছে। দেশের কোনো উপজেলায় ইমপ্লানন (একধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতি) নেই, কোনো উপজেলায় ইনজেকশন নেই। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে কনডম শেষ হয়ে যাওয়ার পথে। জন্মনিরোধক বড়ির যে মজুত আছে, তা দিয়ে চলবে পাঁচ মাসের মতো। এই তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের।

সরকারি পরিসংখ্যানমতে, সক্ষম দম্পতিদের ৩৭ শতাংশ এখন সরকারি খাত থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পান। এনজিওগুলোর কাছ থেকে পান ৩ শতাংশ। বাকি ৬০ শতাংশ পান বেসরকারি খাত থেকে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা বিনা মূল্যে সক্ষম দম্পতির কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পৌঁছে দেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেও এসব সামগ্রী সংগ্রহ করা যায়। এর মধ্যে আছে ইমপ্লানন, কনডম, খাওয়ার বড়ি, জরুরি জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (ইসিপি), আইইউডি, ইনজেকশন ও ইমপ্ল্যান্ট। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেই এসব সামগ্রী সরবরাহ করা হয়।

মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীগুলো ফুরিয়ে গেলে সেবাপ্রার্থীরা পাবেন না। এতে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও ব্যাহত হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এসব নিয়ে মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তাঁরা এতটাই দায়িত্বশীল(!) যে কার্যালয়ে গেলে তাঁদের পাওয়া যায় না, আবার কেউ কার্যালয়ে থাকলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে সমস্যা নিয়ে বলেন না। নানা অজুহাতে এড়িয়ে চলেন।

বিনা মূল্যে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীগুলো সরবরাহ না করলে যে বিপদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেটাই জানিয়েছেন। তাঁর মতে, জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহে ঘাটতি থাকলে দরিদ্র মানুষ বেসরকারি খাতের দিকে ঝুঁকতে পারেন। এতে এর ব্যবহার কমে যেতে পারে এবং অপূর্ণ চাহিদার হার বাড়তে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে চাহিদার অপূর্ণ সামগ্রীর পরিমাণ ১০ শতাংশ। সরকার বলছে, এটি শূন্যে নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু সরবরাহ ও মজুতঘাটতি রেখে সেটা সম্ভব নয়। অতএব যেসব জেলা–উপজেলায় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ঘাটতি আছে, সেগুলো জরুরি ভিত্তিতে পূরণ করা দরকার।

আশা করি, সরকারের নীতিনির্ধারক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বিলম্বে হলেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সচেতন হবেন এবং একটি সফল কর্মসূচিকে ব্যর্থ করে দেবেন না।