প্রকৃতি ধ্বংস করে কেন চিংড়িঘের

বাংলাদেশে যে কটি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারাবন রয়েছে, তার মধ্যে কক্সবাজারের সোনাদিয়া অন্যতম। এই বন রক্ষার দায়িত্ব সরকারের হলেও তারা সেটি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা বন ও মাটি কেটে একের পর এক চিংড়িঘের তৈরি করছেন।

কক্সবাজার শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়া। লাল কাঁকড়া, কাছিম ও বিরল পাখির কারণে এই দ্বীপ সুপরিচিত। একসময় এই দ্বীপ ছিল ৫৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৫২ প্রজাতির শামুক, ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, ৯ প্রজাতির চিংড়ি, ২০৭ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির উভচর, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২০৬ প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং পরিবেশ বিনষ্টের কারণে দ্বীপটির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, সংকটাপন্ন সোনাদিয়া দ্বীপে প্যারাবনের গাছ কেটে চলছে চিংড়িঘেরের নির্মাণকাজ। প্রায় ১ হাজার ১০ একর প্যারাবন ধ্বংস করে ১০টির বেশি চিংড়িঘের নির্মাণ করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ কারণে ঝুঁকিতে আছে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত ছোট দ্বীপ সোনাদিয়া। প্যারাবনের দখল নিয়ে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে গত ২ মার্চ দুজন মারা যান। 

এর আগে গত চার মাসে দ্বীপের প্রায় দুই হাজার একর প্যারাবন নিধন করে ৩৭টি চিংড়িঘের নির্মাণ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ শতাধিক প্রভাবশালী। এ নিয়ে গত ১৩ জুন প্রথম আলোয় ‘সংকটাপন্ন সোনাদিয়াতে গাছ কেটে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাছ চাষ’ শীর্ষক সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা বলেছেন, প্রতিবেদন প্রকাশের পর কিছুদিন চিংড়িঘের নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখা হলেও ২০ জুন তা আবার শুরু হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আইনজীবী জাকিয়া সুলতানা বলেছেন, উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবনের গাছ কেটে চিংড়িঘের তৈরি আদালত অবমাননার শামিল। বন রক্ষায় আবার আদালতে যাবেন তাঁরা। কিন্তু প্রশাসন যদি আদালতের নির্দেশনা না মানে, তাহলে বন রক্ষা হবে কী করে?

ইকোট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার জন্য সরকার নামমাত্র সেলামিতে (১ হাজার ১ টাকা) সোনাদিয়ার ৯ হাজার ৪৬৬ দশমিক ৯৩ একর বনভূমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে প্যারাবন পড়েছে অন্তত ৮ হাজার একর। ২০১৭ সালের মে মাসে বেজা উপকূলীয় বন বিভাগের কাছ থেকে তা অধিগ্রহণ করলেও নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। 

গত ২৭ জুন প্রথম আলোর প্রতিনিধি সরেজমিনে দেখতে পান, আট-নয়টি খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে চিংড়িঘেরের বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ চলছে। ইতিমধ্যে শ্রমিকেরা গাছপালা কেটে সাফ করেছেন। কিছু অংশে পেট্রল ঢেলে আগুনে গাছপালা পুড়িয়ে ফেলার দৃশ্য চোখে পড়ে। এর অর্থ সোনাদিয়ায় আইনের শাসন নেই, আছে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ শাসন। 

মহেশখালীর ইউএনও মীকি মারমা বলেন, প্যারাবন নিধন করে চিংড়িঘের নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বেজা কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা মামলা করেনি। বেজা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে অবৈধ চিংড়িঘের উচ্ছেদে অভিযান চালানো হবে। 

কিন্তু এত দিন সমন্বয়ের কাজটি তাঁরা করলেন না কেন? বেজা চিংড়িঘেরের মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে স্থানীয় প্রশাসনেরও তো দায়িত্ব আছে। ইউএনও তাঁর দায়িত্ব পালন করুক। এরপর বেজাকে বলা যাবে। 

সরকার যে দ্বীপকে পরিবেশের জন্য সংকটাপন্ন বলে ঘোষণা করে, সেই দ্বীপে কী করে অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটাও প্রশ্ন বটে।