সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

হত্যাচেষ্টা মামলা

৫৩ সাবেক সচিবকে আসামি করার যুক্তি কী

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমন করতে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বিচার গুলি চালিয়ে শিশু–নারীসহ কয়েক শ মানুষকে হত্যা করে। আহত হন কয়েক হাজার মানুষ। আমরা মনে করি, প্রতিটি ঘটনার বিচার হওয়া উচিত।

কিন্তু মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে যদি মারাত্মক ত্রুটি থাকে কিংবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে আসামি করা হয়, তাহলে ন্যায়বিচার পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে মামলা করেছেন ছাত্রদলের সাবেক নেতা মোহাম্মদ জামান হোসেন খান। তাঁর করা মামলায় মোট ১৯৬ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে ৫৩ জন সাবেক সচিব। আসামিদের মধ্যে আরও আছেন মাত্র এক মাস আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পদ থেকে অবসরে যাওয়া মো. মাহবুব হোসেন।

মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও দলের নেতাকেও আসামি করা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন মামলায় বিচ্ছিন্নভাবে সাবেক কয়েকজন সচিবকে আসামি করা হয়েছে। তবে একটি মামলায় একসঙ্গে ৫৩ জন সাবেক সচিবকে আসামি করার ঘটনা এটিই প্রথম।

মামলার এজাহারে বাদী জামান হোসেন খান উল্লেখ করেছেন, তাঁর মেয়ে সামিয়া খান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ বনশ্রী শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে যোগ দিতে সামিয়া আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যায়। ছাত্র-জনতার মিছিল চলার সময় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করতে থাকে। এ সময় সামিয়া গুলিবিদ্ধ হয়।

যেখানে বাদী নিজেই স্বীকার করেছেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গুলিতে তাঁর মেয়ে আহত হয়েছে, সেখানে পাঁচ বছর বা তারও আগে অবসরে যাওয়া সচিবদের আসামি করার কী যুক্তি থাকতে পারে? তিনি বলেছেন, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে যাঁরা সচিব হয়েছেন, তাঁদের ভূমিকা ছিল অগ্রহণযোগ্য। তাঁরা সরকারকে ঠিকমতো পরামর্শ দেননি। নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি।

কেউ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেই তাঁকে হত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করা যায়? সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে বাদী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ মামলা করতে পারতেন। আসামিদের তালিকায় থাকা জেসমিন টুলি বর্তমানে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এখন তাঁকেই হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি করে সেই প্রশংসনীয় কাজের ‘পুরস্কার’ দেওয়া হলো।

এক মামলায় ৫৩ জন সাবেক সচিবকে একসঙ্গে আসামি করার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি দণ্ডবিধি অনুযায়ী জেনেশুনে ইচ্ছে করে কাউকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে মামলা করলে তা অপরাধ। দুর্ভাগ্য যে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করলে কারও বিরুদ্ধে এত দিন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মামলায় যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে, তাঁদের কেউ হয়তো পাঁচ বছর আগে দায়িত্বে ছিলেন।

এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও ঢালাও মামলা না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশনা যে মানা হচ্ছে না, ছাত্রদলের সাবেক নেতার মামলাই তার প্রমাণ। এ রকম আরও বহু মামলা আছে। অনেক মামলার বাদী আসামিদেরই চেনেন না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের পরামর্শে আসামিদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মামলাটিই দুর্বল হয় না, ন্যায়বিচারের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়।

 বিষয়টির প্রতি স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।