চালের দাম বাড়লে যে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়ে, সেটা নিশ্চয়ই সরকারের নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। বাজারে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়লে মানুষ কম কিনে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু চালের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। দাম যত বেশিই হোক না কেন, প্রয়োজনমতো চাল তাঁকে কিনতেই হবে। কঠিন বাস্তবতা হলো, গরিব মানুষের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করতে হয় চাল কিনতে।
ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরু চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে। মাঝারি মানের চালের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৮ টাকা এবং মোটা চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। বর্তমানে মিনিকেট চাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়, যা তিন সপ্তাহ আগে বিক্রি হতো ৬৮ থেকে ৭৮ টাকায়। একইভাবে নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৮ থেকে ৯০ টাকায়, যা তিন সপ্তাহ আগে বিক্রি হতো ৭২ থেকে ৮২ টাকায়। যেখানে বিআর-২৮ চাল আগে ৬৪ থেকে ৬৬ টাকায় বিক্রি হতো, এখন বিক্রি হয় ৫৮ থেকে ৬২ টাকায়। পাইজাম আগে বিক্রি হতো ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায়, এখন হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৫ টাকায়।
এমন সময়ে চালের দাম বাড়ল, যখন আমনের ভরা মৌসুম। সাধারণত খরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ে আর ভরা মৌসুমে কমে। এবার হয়েছে তার বিপরীত। গত ১৭ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গত দুই সপ্তাহে চালের দাম বস্তাপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ার জন্য মিলমালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের দায়ী করেন। বড় ব্যবসায়ীরা বাজারে যখন দাম কম থাকে, চাল কিনে মজুত করেন, আর যখন বাড়তি থাকে, তখন বিক্রি করেন। বাজারবিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে চালের অভাব নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীরা নানা কারসাজি করে দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অতীতে দাম বাড়ানোর জন্য যে সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল, তারা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, এটাও মনে করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু গত পাঁচ মাসেও সরকার বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, এ রকম প্রমাণ নেই।
যেকোনো পণ্যের দাম স্থিতিশীল করতে সরকারকে দুটি উদ্যোগ নিতে হয়। প্রথমত, নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সরবরাহ বাড়ানো। দ্বিতীয়ত আমদানি করে ঘাটতি পূরণ। গত নভেম্বরে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে চালের আমদানিরও সব শুল্ক তুলে নেয় এবং বেসরকারি খাতের ২২৭টি প্রতিষ্ঠানকে আমদানির অনুমতি দেয়। এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রতিষ্ঠানগুলো কি প্রতিশ্রুত চাল আমদানি করেছে? যদি করে থাকে, তাহলে বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়ল না কেন?
আমরা মনে করি, খোলাবাজারে সাশ্রয়ী দামে চাল বিক্রি করলে দাম কমে আসতে বাধ্য। তবে সেটা লোকদেখানো হলে হবে না। টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের দীর্ঘ সারিই বলে দেয় তাঁরা কত কষ্টে আছেন। দিনের কাজ ফেলেও অনেককে ট্রাকের পেছনে দাঁড়াতে হয়। আবার সারিতে দাঁড়ালেই যে সবাই চাল পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। অনেক সময় সারির পেছনের মানুষকে বিমুখ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি সরকার কিংবা সাধারণ মানুষ কারও জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। চালের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে মানুষের আয় বাড়েনি। ধানের উৎপাদনে যখন ঘাটতি নেই, ব্যবসায়ীদের কাছে যখন যথেষ্ট মজুতও আছে, তখন কেন সেই চাল যৌক্তিক দামে ভোক্তার কাছে পৌঁছাবে না? চালের মজুত করে যারা বাজার অস্থিতিশীল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।