সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক

পাইকারি গ্রেপ্তার ও মামলা নয়

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি ছিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ। সেটি কীভাবে ও কাদের উসকানিতে প্রাণঘাতী সংঘাতে রূপ নিল, তা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে। সব দায় কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না। যারা রাষ্ট্রীয় কিংবা বেসরকারি সম্পদ ধ্বংস করেছে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তদন্তের আগেই যখন সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে কারও ওপর দায় চাপানো হয়, তখন জনমনে সন্দেহ না জেগে পারে না।

বিরোধী দলের শত শত নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার (কাউকে কাউকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে) এবং হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা করা হচ্ছে, সেটাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা কঠিন। বিভিন্ন স্থানে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদেরও সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। অথচ মামলা করা হচ্ছে বেছে বেছে শিক্ষার্থী ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এটা আইন নিজস্ব গতিতে চলার লক্ষণ নয়।

অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের ঢালাও গ্রেপ্তার ও গয়রহ মামলার মাধ্যমে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই ঘায়েল করা হয় না, একধরনের গ্রেপ্তার–বাণিজ্যও চলে। এবার তা ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী? অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করে গ্রেপ্তার–বাণিজ্যের পুনরাবৃত্তি কোনোভাবে কাম্য নয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের তিন সমন্বয়ক তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সরকারের কাছে যে আট দফা দাবি পেশ করেছিলেন, এখনো তার সুরাহা হয়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার ৯৩ শতাংশ মেধা ও ৭ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করে পরিপত্র জারি করেছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ১ নম্বর দাবি পূরণ হয়েছে বলে আশা করা যায়। যদিও সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, নারীদের জন্য কোনো কোটা না রাখা সরকারের ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতির পরিপন্থী।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খুলে দেওয়া, হত্যাকাণ্ডের বিচার, ক্যাম্পাসে দখলদারির অবসান ও ছাত্র সংসদ চালু ও আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের যে দাবি জানিয়েছেন, সেসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান এখনো পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীরা ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। গতকাল মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি।

সরকার পর্যায়ক্রমে কারফিউ শিথিল করছে। তিন দিন সাধারণ ছুটির পর বুধবার সরকারি-বেসরকারি সব দপ্তর বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না—সরকারের কাছে শিক্ষার্থীদের এই দাবি সত্ত্বেও একের এক আন্দোলনকারী নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ আসছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল খোলার সময়সূচি ঘোষণা করতে হবে।

সরকার যেখানে বলেছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। এই আন্দোলনে যদি কোনো রাজনৈতিক দল সমর্থন দিয়ে থাকে, সেটি অপরাধ হতে পারে না। অপরাধ হবে তখনই যদি কেউ আন্দোলন দমন কিংবা সমর্থনের নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায়; রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে। সে ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে উপযুক্ত তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে। ঢালাও গ্রেপ্তার কিংবা পাইকারি মামলা বিচারপ্রক্রিয়াকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করবে, তেমনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রেও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।