সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়

বিচারাধীন মামলায় আটকদের মুক্তি দিন

দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের স্থলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদে এটি পাস হওয়ার কথা। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া অনুযায়ী আগের আইনের অনেক ধারা জামিনযোগ্য করা ও শাস্তি কমানো হলেও দুটি আইনের চরিত্রগত পার্থক্য তেমন নেই।

ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমের অংশীজনসহ বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও। সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া পর্যালোচনা করতে গিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দমনমূলক বিধিগুলো রয়ে গেছে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে তুলনায় দেখা যাচ্ছে, এই অনুচ্ছেদে একটি ছাড়া সব অপরাধের বিষয় একই আছে। এ ক্ষেত্রে শুধু একটি পরিবর্তন আনা হয়েছে—অপরাধের ধরনে নয়, শাস্তির ক্ষেত্রে। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২৫ (মিথ্যা বা আপত্তিকর তথ্য প্রকাশ), ধারা ২৯ (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ) এবং ধারা ৩১ (আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর শাস্তি) সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় অবিকৃত রয়েছে। ২৯ ধারায় শুধু কারাদণ্ডের বদলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

খসড়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন’ করার মতো বিষয়ের কোনো ব্যাখ্যা না থাকার বিষয়টিও অপব্যবহারের যথেচ্ছ সুযোগ থাকবে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটার উপক্রম হয়, তাহলে ওই ব্যক্তির অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকায় এই ধারার অপপ্রয়োগের ঝুঁকি থাকছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াতেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১ (মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে প্রচারণা) এবং ধারা ২৮ (ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত) রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধারা সাইবার নিরাপত্তায় ৪২ ধারা হিসেবে অবিকৃত রয়েছে। এ ধারায় পুলিশ কর্মকর্তা কোনো অফিসে তল্লাশি, কম্পিউটার বা এ-জাতীয় যেকোনো যন্ত্র জব্দ, কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি; এমনকি পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারবে। নতুন এই আইনও সাংবাদিকদের ভয় দেখানো, হয়রানি, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও ভিন্নমত দমনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতে পারে।

একই সঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচারাধীন মামলায় আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ারও সুপারিশ করেছে। আমরা মনে করি, ন্যায়বিচারের স্বার্থেই সরকারের উচিত এই সুপারিশ আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। গত সাড়ে চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খুব কম মামলাই নিষ্পত্তি হয়েছে। ফলে এই আইনে আটক অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মাসের পর মাস, কেউবা বছরের পর বছর কারান্তরীণ। এ প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার কথা উল্লেখ করা যায়। ১১ মাসের বেশি সময় ধরে তিনি কারাগারে থাকায় তাঁর উচ্চশিক্ষাই বন্ধ হওয়ার পথে। খাদিজার মতো আরও যেসব অভিযুক্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক আছেন, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। যেহেতু প্রস্তাবিত আইনের অনেক ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে, সেহেতু সেসব ধারায় আগের আইনে আটক ব্যক্তিরা ন্যায়সংগতভাবেই জামিন পাওয়ার অধিকারী।