সরকারি প্রকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত থাকেন, তাঁরা কি ধরেই নিয়েছেন যে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়াটা কারও দায় ও দায়িত্বের অংশ নয়। না হলে কেন দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি সব প্রকল্পের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়বে, বাড়বে বাজেট। অদক্ষতা, গাফিলতি, অব্যবস্থাপনা যা-ই বলি না কেন, এর সঙ্গে দুর্নীতির সংযোগ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) দুটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে সমস্যাটি আরও কয়েক কাঠি সরেস। প্রকল্প দুটি হলো ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা এবং ছাতক সিমেন্ট কারখানা।
দুটি ক্ষেত্রেই মেয়াদ ও প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে দফায় দফায়। প্রথমটির ক্ষেত্রে নির্মাণ ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা, পরেরটির ক্ষেত্রে ৯০০ কোটি টাকা। গ্যাস সরবরাহসহ আরও কিছু কারণে কারখানা দুটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, ইউরিয়া সার কারখানাটি উৎপাদনে যাওয়ার আগেই ঋণের কিস্তি শোধ করতে হচ্ছে। কারখানাটির জন্য উচ্চ সুদে বাণিজ্যিক ঋণ নেওয়া হয়েছে। ডলার-সংকট ও রিজার্ভ কমে আসায় অর্থনীতি যখন বড় চাপের মধ্যে, সে সময় উৎপাদনে না আসা একটি কারখানার কিস্তি শোধ করা নিঃসন্দেহে অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ ফেলছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, ঘোড়াশাল ও পলাশ সার কারখানাকে একীভূত করে ‘ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা’ প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যয় বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশে বছরে ইউরিয়া সারের চাহিদা যেখানে ২৬ লাখ টন, সেখানে দেশে উৎপাদন হয় ১০ লাখ টন। নতুন কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা ৯ লাখ ২০ হাজার টন। ফলে ইউরিয়া সারের আমদানিনির্ভরতা কমাতে এই প্রকল্প নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু কারখানা চালাতে দৈনিক যে ৭ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন, তার জোগান আসবে কোথা থেকে?
কেননা, নতুন কারখানাটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করতে যে গ্যাস প্রয়োজন, তা সরবরাহ করতে গিয়ে বিসিআইসির চারটি ইউরিয়া সার কারখানার একটি যমুনাকে বন্ধ রাখতে হয়েছে। বিসিআইসি, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, ঘোড়াশাল পলাশ সার কারখানা কর্তৃপক্ষ কেউই গ্যাসের জোগানের ব্যাপারে সদুত্তর দিতে পারেনি।
ইউরিয়া সার উৎপাদনের যে জ্বালানি প্রয়োজন এবং সার তৈরির কাঁচামালের একটি উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। ফলে গ্যাসের জোগান নিশ্চিত না করে কারখানা তৈরি করার যৌক্তিকতা কী? বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে জ্বালানির উৎস নিশ্চিত না করে অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে সরকারের বিপুল অর্থ অপচয় হয়েছে।
কারখানাটি থেকে উৎপাদিত সারের ৪০ শতাংশ রেলপথে পরিবহনের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজও শুরু হয়নি। ফলে বিপুল ব্যয়ে এত বড় কারখানা করার পরও যদি সেটি ঠিকঠাক উৎপাদনে না যেতে পারে, তার থেকে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় আর কী হতে পারে?
নবনির্মিত ছাতক সিমেন্ট কারখানার ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, ৬৬৭ কোটি টাকার প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর থেকে বাড়িয়ে সাত বছর করা হয়েছে। প্রকল্প ব্যয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। নতুন প্রযুক্তির কারখানাটি উৎপাদনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেও গ্যাসলাইন স্থাপন, ভারত থেকে পাথর আমদানি এবং আমদানির জন্য রোপওয়ে নির্মাণের জটিলতায় উৎপাদন কবে শুরু হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করে ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা এবং ছাতক সিমেন্ট কারখানা দ্রুত চালু করুন। নির্মাণের পর কারখানা চালু না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। এতে শুধু জনগণের করের মূল্যবান অর্থের অপচয় হয়। সরকারি প্রকল্পের সব জায়গাতেই সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।