যেখানে বেসরকারি হোটেলে উপচে পড়া ভিড়, সেখানে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের স্থাপনাগুলো পর্যটক টানতে পারছে না। এই ব্যর্থতার দায় কার?
আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বাপক)। এখন দেশীয় মানও ধরে রাখতে পারছে না। সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, পর্যটন করপোরেশনের হোটেল-মোটেলগুলোর বেশির ভাগেরই অবস্থান আকর্ষণীয় স্থানে। নিরাপত্তাব্যবস্থাও ভালো। এরপরও সেখানে পর্যটক না আসার কারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাদারত্বের ঘাটতি, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও আমলানির্ভরতা।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের অধীন ৫১টি হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ ও বার রয়েছে। এর মধ্যে করপোরেশন পরিচালনা করে ৩৫টি ইউনিট, ইজারা দেওয়া হয়েছে ১৬টি। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) পর্যন্ত গড়ে ১০ কোটি টাকা করে লোকসান গুনতে হয়েছে তাদের।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩৫টি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের মধ্যে ৩৩টি আয়ের লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি।
বিস্ময়কর হলো, কক্সবাজারে ১৯৭২ সালে মোটেল উপল চালু হওয়ার পর আর সংস্কার করা হয়নি। মোটেলটিতে কক্ষ রয়েছে ৩৮টি। এর মধ্যে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ভাড়া হয় ১২টি, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৬টি। বছরের বেশির ভাগ সময় গড়ে ১০-১২টি কক্ষ ভাড়া হয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদক মোটেলটি ঘুরে দেখেছেন, মোটেলটির আসবাব পুরোনো, কক্ষগুলো স্যাঁতসেঁতে। অন্যদিকে লাবণীর ৬০টি কক্ষের মধ্যে দুই বছর ধরে পরিত্যক্ত ১৫টি। বাকি ৪৫টির অবস্থাও খারাপ। এসব কক্ষের মধ্যে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ভাড়া হয় চারটি, ১২ ফেব্রুয়ারি তিনটি। গড়ে প্রতিদিন তিন-চারটির বেশি কক্ষ ভাড়া হয় না।
এ রকম অবস্থায় পর্যটকেরা নিরুপায় না হলে সেখানে যাবেন, এটা ভাবার কারণ নেই। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার পরিবার–পরিজন নিয়ে হোটেলে এসেছিলেন। কিন্তু সবকিছু দেখে বললেন, ‘এখানে থাকার অবস্থা নেই বলে ফিরে যাচ্ছি।’ এই ফিরে যাওয়া পর্যটকদের ধরে রাখার কোনো চেষ্টা পর্যটন করপোরেশন কিংবা হোটেল কর্তৃপক্ষের নেই। তাঁরা সেখানে চাকরি করেন মাত্র।
প্রথম আলোর খবর থেকে আমরা আরও জানতে পেরেছি, অনেক স্থানে রাজনৈতিক বিবেচনায়ও পর্যটনের হোটেল স্থাপন করা হয়েছে। আকর্ষণীয় স্থানে হোটেল–মোটেল করেও যেখানে পর্যটক টানা যাচ্ছে না, সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনা পর্যটন কেন্দ্র করলে কী পরিস্থিতি হতে পারে, সহজেই অনুমেয়।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও অব্যবস্থা দূর করার চেয়েও জরুরি হলো মানসিকতার পরিবর্তন। পর্যটকদের চাহিদা ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। কেবল আকর্ষণীয় স্থানে স্থাপনা করাই যথেষ্ট নয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান পর্যটন করপোরেশনের আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক করতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন। সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারাও আধুনিকায়নের কথা বলেছেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি তাঁদের করা প্রয়োজন তা হলো, এত দিন এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ কেন নেওয়া হলো না?
আমাদের বক্তব্য হলো যেসব প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে, সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া হোক। লোকসানের বোঝা বাড়ানো যাবে না। সংস্থার যেসব ব্যক্তি পেশাদারত্ব দেখাতে পারবেন না, প্রতিষ্ঠান লাভজনকভাবে চালাতে পারবেন না, তাঁদের বাদ দিতে হবে।
কেবল বক্তৃতা-বিবৃতি নয়; পর্যটন করপোরেশনের হোটেল–রেস্তোরাঁগুলো লাভজনক করতে অবিলম্বে টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার নেওয়া হোক। ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা নয়, প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।